২৯ মহানির্বাণ মঠ রোড, কলকাতা ৭০০০২৯। এই বাড়িতে আমার জন্ম হয়েছিল শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর ১৯৮৭, সকাল ৯টা ১০ মিনিটে। বললাম বটে, আমার জন্ম হয়েছিল এই বাড়িতে। কিন্তু সঠিক ভাবে দেখতে গেলে আমার জন্ম হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান (শিশুমঙ্গল) হাসপাতালে। এই বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের কিছুটা দূরে পণ্ডিতিয়া অঞ্চল। রাসবিহারী রোড বা কালীঘাটের দিক থেকে আসলে ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক ক্রসিং–এর কাছে। কাছেই বিখ্যাত মন্দির মহানির্বাণ মঠ আর সেই থেকেই রাস্তার নাম মহানির্বাণ মঠ রোড বা মহানির্বাণ রোড।
২৯ মহানির্বাণ মঠ রোডের বাড়ি আমার বাবার কলকাতা শহরে পৈতৃক ভিটে। যতদুর সম্ভব আমার ঠাকুরদা আদিত্যচন্দ্র দত্ত এই বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। এই বাড়ি যে শতাব্দী প্রাচীন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক কোন বছরে এই বাড়ি নির্মাণ হয় তা আমার জানা নেই। এই পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করা হয় ১৯৯৩ বা ১৯৯৪ সালে। আজ এই বাড়ি পরিত্যক্ত, ভাঙা। কলকাতা কর্পোরেশনের তরফ থেকে বহু বছর আগেই একে "বিপজ্জনক ভঙ্গুর বাড়ি" তকমা লাগানো হয়েছে। যখন তখন ইঁট–পাথর খসে পড়তে পারে এবং পড়েও। এখনও সেই তকমা নিয়েই মহানগরীর বুকে জরাজীর্ণ এই বাড়ি কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বাবা তরুণ দত্ত মারা যান সোমবার, ৪ মে ১৯৯৮। তার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই, মানে বাড়ি বিক্রির পর থেকেই, জেঠু বা পিসিদের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। এই পুরনো বাড়ির অনেক তথ্য হারিয়ে গেছে। অথচ এই বাড়িতেই আমার জীবনের প্রথম ৫‒৬ বছর কেটেছে। সুদূর শৈশবের স্মৃতি, খুব আবছা কিছু কথা মনে আছে। সেই স্মৃতির নির্বাচিত কিছু অংশ, বিশেষ করে যা আমার মাকে ঘিরে, লেখার চেষ্টা করবো। তার সাথে কিছু তথ্য, যতটা খুঁজে পাই, সংকলন করার চেষ্টা করবো। এই অধ্যায়টিকে একাধিক পরিচ্ছেদে বিভক্ত করার প্রয়োজন হবে।
![]() |
| আমার মায়ের বিয়ের দিনের ছবি। ১৯৮৪ সাল। মহানির্বাণ মঠ রোডের বাড়িতে। ছবির মাঝখানে লাল শাড়ি পরে বসে আছেন মা। জেঠিমা, পিসি এবং বাবার দিকের অন্যান্য আত্মীয়রা রয়েছেন। |
বাড়ির কথা
২৯ মহানির্বাণ মঠ রোডের এই বাড়ি ঠিক কোন সালে নির্মিত হয়, আমার জানা নেই। তবে, নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে এই বাড়ির নির্মাণ ১৯১৫ বা তার আগে।
আমার বাবার জন্ম ৪ মে ১৯৩৩। আমার বাবা তাঁর ভাই–বোনদের মধ্যে সব থেকে ছোট ছিলেন। আমার ঠাকুরদা এবং জেঠু পিসিদের অনেকের সঠিক জন্মসাল আমার জানা নেই।
আমি ১৯৫৬ এবং ১৯৬১ সালের কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউ অঞ্চলের ইলেক্টোরাল রোলের কপি পেয়েছি। আসুন, সেই ভোটার তালিকার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অতীতকে কিছুটা পুনরুদ্ধার করা যাক।
![]() |
| ১৯৫৬ সালের রাসবিহারী অ্যাভিনিউ কেন্দ্রের ভোটার তালিকা। প্রেমিসেস নম্বর ২৯, আর সিরিয়াল নম্বর ৪২৪–৪৪৮ দেখবেন। |
![]() |
| ১৯৬১ সালের ভোটার তালিকা। প্রেমিসেস নম্বর ২৯–এর তালিকা লক্ষ্য করবেন। |
আপনি এই অংশটি এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে পুরনো ডকুমেন্ট ঘেঁটে ৮০–১০০ বছরের পুরনো তথ্য খুঁজে বেড় করা কিছুটা কঠিন কাজ। তাই অনুগ্রহ করে একটু মনোযোগ দেবেন।
আমার ঠাকুরদা আদিত্যচন্দ্র দত্তের জন্ম হয়েছিল ১৮৯০ সালে। আমার ঠাকুরমা হিমাংশুবালা দত্তের জন্ম ১৮৯৮ সালে। আমার ঠাকুরদার বাবা, মানে আমার প্রপিতামহের নাম ছিল প্রফুল্লচন্দ্র দত্ত। প্রফুল্লচন্দ্রের সম্পর্কে আর কোনও তথ্য আমার কাছে এখন নেই।
![]() |
| আমার ঠাকুরদা আদিত্যচন্দ্র দত্ত (বামদিকে) এবং ঠাকুরমা হিমাংশুবালা দত্ত (ডানদিকে)। |
আমার সবথেকে বড়ো জেঠু অরুণকুমার দত্তের জন্ম ১৯১৮ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছর আগে। অরুণকুমারের স্ত্রী, আমার বড় জেঠিমা, প্রতিমা দত্তের জন্ম ১৯২২।
আমার মেজ জেঠু কল্যাণ দত্তের জন্ম ১৯২০ সালে। তাঁর স্ত্রী, আমার মেজ জেঠিমা, প্রীতিকণা দত্তের জন্ম ১৯২৭।
সেজ জেঠু শ্যামলকুমার দত্তের জন্ম ১৯২২ সালে। ইনি নাট্য এবং সংস্কৃতিচর্চার সাথে বিশেষ যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে ইনি আত্মহত্যা করেন। এইখানে একটা তথ্য দিই। আমার জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৯৮৭। আমার যে নাম "টিটো" এইটা আসলে আমার ডাকনাম। আমার ভালো নাম হওয়া উচিত ছিল অনির্বাণ দত্ত। জন্মের পর সাময়িকভাবে টিটো নাম দেওয়া হয়েছিল। সেজ জেঠু, শ্যামল দত্ত, এই নাম দিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। আমার তখন কয়েক মাস মাত্র বয়স, আমার মায়ের কাছ থেকে এই ঘটনা শোনা। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার নামকরণ করা হবে। তার কিছু দিন আগে সেজ জেঠু একদিন দুপুরে মা আর আমাকে দেখতে এলেন। আমাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমার মাকে বললেন— "স্বপ্না, দেখো, এই ছেলে, টিটো, একদিন খুব বড় মানুষ হবে। আমি হয়তো সেদিন থাকবো না। কিন্তু, টিটো নিশ্চয়ই খুব বড়ো হবে।" এই কথা শুনে মা একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন— "সেজদা, আপনি এইরকম বলছেন কেন, যে আপনি থাকবেন না?" মা সেই দিনই তাঁর প্রশ্নের উত্তর পাননি। উত্তর পেয়েছিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে। আমার সেজ জেঠু শ্যামল দত্ত গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। আমার বাবা সেজ জেঠুর গলার দড়ি কেটে তাঁর ঝুলন্ত মৃতদেহ নামিয়েছিলেন। এখন যেহেতু সেজ জেঠু আমার নাম টিটো দিয়েছিলেন, আর কিছু দিন পরেই মারা গেছিলেন, আমার ডাকনামটাই ভালো নাম হয়ে রইলো। আমার সেজ জেঠিমা অঞ্জলি দত্তের জন্ম হয়েছিল ১৯৩২ সালে।
![]() |
| শ্যামল দত্ত। আমার সেজ জেঠু। ইনি আমার নাম টিটো রেখেছিলেন। |
আমার চতুর্থ জেঠু অশোককুমার দত্তের জন্ম হয়েছিল ১৯২৪ সালে। ইনি সাংবাদিক ছিলেন। চণ্ডাশোক নামে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ইনি একজন গণিকা মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। তার জন্য আমার ঠাকুরদা এনাকে হয় ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন বা করতে চেয়েছিলেন। এনার সংসার সুখের হয়নি। আমি বলছি ১৯৬০–এর দশকের কথা। তখন কলকাতা এবং বাঙালি সমাজ আরও বেশি সংরক্ষণশীল ছিল। বিয়ের কয়েক বছর কী ভাবে যেন জেঠিমা হারিয়ে যান। তাঁর সম্পর্কে আর কোনও তথ্য পাইনি। ১৯৫৬ এবং ১৯৬১ সালের ভোটার তালিকায়ও এনার নাম পাইনি। বোধ হয়, এই বাড়িতে থেকে এনার নাম নথিবদ্ধ হয়নি। অশোক জেঠুর এক মেয়ে হয়েছিল। সেই মেয়েও শৈশবে অল্প কয়েক বছর বয়সে জ্বরে ভুগে হঠাৎ মারা যায়। এরপর অশোক জেঠু সব ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যান। এরপর তাঁর দেখা বা তাঁর খবর কেউ কোনোদিন পায়নি। আমার মা–বাবার বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। অশোক দত্তকে ঘিরে এইসকল ঘটনা এবং তাঁর গৃহত্যাগ, সবকিছু হয়েছিল ১৯৮৪–এর অনেক বছর আগে। আমার জেঠু–পিসিদের মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে অশোক দত্তকে নিয়ে সবথেকে বেশি আগ্রহী। তবে, আমার কাছে তথ্য অত্যন্ত সীমিত।
আমার পঞ্চম জেঠু তাপসকুমার দত্ত, জন্ম ১৯২৯। তিনি বিবাহ করেন মাধবীলতা দত্তকে, জন্ম ১৯৩৯। আমার ষষ্ঠ জেঠু মানসকুমার দত্তের জন্ম ১৯৩২ সালে। আর ভাই–বোনদের মধ্যে সবথেকে ছোট, আমার বাবা, তরুণ দত্তের জন্ম ১৯৩৩ সালে।
আমার দুই পিসি ছিলেন অর্চনা দত্ত এবং সাধনা দত্ত। দুজনেরই জন্ম ১৯৩০ সালে। দুইজনের একই সালে জন্ম — এইখানে একটু তথ্যের অসঙ্গতি থাকতে পারে, আবার সঠিকও হতে পারে। তবে আমি ১৯৫৬ সালের ভোটার তালিকা অনুসরণ করছি। এর থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র আমার কাছে আরে নেই। অর্চনা বিবাহ করেন রবি রায়কে, এবং সাধনা বিবাহ করেন চিত্তরঞ্জন ধরকে।
আমার ঠাকুরদা আর ঠাকুরমা দুজনেরই মৃত্যু হয় আমার মা–বাবার বিয়ের (১৯৮৪) বেশ কিছু বছর আগে। ১৯৯৩–১৯৯৪ সালে যখন এই বাড়ি বিক্রি হচ্ছে তখন সেই টাকা সাত ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়েছিল। পিসিরা কোনও ভাগ নেননি।
আমাদের আর্থিক অবস্থা সেই সময় ভালো ছিল না। বাড়ি বিক্রির যেই টাকা আমরা পেয়েছিলাম, তার একটা বড় অংশ আমাদের চলে গিয়েছিল ধার বাকি শোধ করতে। সেইটা এক অদ্ভুত সময় ছিল। আমার আবছা মনে আছে যে জেঠুদের পরিবার এক এক করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, অন্য কোথাও বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনে। একটা বড় পরিবার, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে একসাথে ছিলেন, ধীরে ধীরে ভেঙে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলেন। আমার মনে আছে সেইসময় একজন করে আত্মীয় বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন, আর আমার বাবা আর মা দুঃখে কাতর হয়ে পড়তেন।
![]() |
| ২৯ মহানির্বাণ মঠ রোডের বাড়ি। ২৫ জুন ২০১৪ তারিখে তোলা ছবি। প্যানোরামা ভিউতে বাড়ির দুইদিকের ছবি সংযুক্ত। |
বাড়ি বিক্রির পর আমরা চলে আসি হালতু কায়স্থপাড়ার একটা দুই কামরার ভাড়া ঘরে। বাহাদুর সিং নামক এক প্রোমোটার মহানির্বাণ মঠ রোডের বাড়িটা কিনেছিলেন। বাড়ি কেনার কয়েক বছর পর তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিছু আইনি এবং অন্যান্য জটিলতাও ছিল। ধীরে ধীরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়ি ভেঙে পড়তে থাকে। ২০০৬–২০০৭ সাল নাগাদ যখন ওই অঞ্চলে একবার গেছিলাম, দেখেছিলাম যে বাড়িটা "বিপজ্জনক ভঙ্গুর" নোটিস পেয়েছে। এখনও বাড়িটা ওই অবস্থাতেই রয়েছে। বেশ কিছু আইনি জটিলতা, আর প্রচুর প্রপার্টি ট্যাক্স আর নানা ট্যাক্স বাকি আছে। তাই নতুন করে কোনও প্রোমোটার বা ব্যক্তি কিনতে চাইছেন না বা পারছেন না। দিনে দিনে বাড়িটার কঙ্কাল আরও বেশি করে বেরিয়ে পড়ছে।
সপ্তম অধ্যায়, প্রথম পরিচ্ছেদ এইখানেই শেষ করলাম। চরৈবেতি।
স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)
- ● বাংলায় পড়ুন: প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় অধ্যায় (সংযোজন), চতুর্থ অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, তৃতীয় পরিচ্ছেদ), পঞ্চম অধ্যায়, ষষ্ঠ অধ্যায়, সপ্তম অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ)
- ● Read in English: First Chapter, Second Chapter, Third Chapter (Addendum), Fourth Chapter (Part I, Part II, Part III), Fifth Chapter, Sixth Chapter, Seventh Chapter (Part I)
This page was last updated on: 2 September 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here






No comments:
Post a Comment
Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.