Wednesday, August 06, 2025

স্বপ্না দত্ত, আমার মা: তৃতীয় অধ্যায়

আমার মা স্বপ্না দত্তের শ্রাদ্ধকার্য আগামী ৮ অগাস্ট ২০২৫ (২২ শ্রাবণ ১৪৩২), শুক্রবার, দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে বিবেকনগর কালীবাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০:৩০–টা নাগাদ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শুরু হবে। প্রথমার্ধে উপাসনা–যজ্ঞ–পিণ্ডদান। কালী মন্দিরের পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে এই কাজ সম্পন্ন হবে।

দ্বিপ্রহরের সময়— দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টে অবধি শ্রাদ্ধকার্যে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের আহারাদির বন্দোবস্ত হবে। এখন অবধি যা স্থির হয়েছে সেই অনুযায়ী শ্রাদ্ধের দিন আপ্যায়িতদের ভোজনে পরিবেশিত অন্নসামগ্রী হবে— ভাত, ডাল, শুক্তো, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, ধোকার ডালনা, পনিরের তরকারি, চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা এবং মালাই সন্দেশ। এখন অবধি প্রায় ৭০ সুধীজন নিমন্ত্রিত। এই সংখ্যাটি আর সামান্য কিছু বাড়তে পারে। বিবেকনগর কালীবাড়ির রন্ধন–বিভাগই এই রান্না এবং পরিবেশনের আয়োজন করবে। আমরা শুধু মিষ্টি (রসগোল্লা, সন্দেশ) বাইরে (কালীমন্দিরের কাছেই "শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার") থেকে কিনে রন্ধন–বিভাগের আয়োজকদের কাছে পৌঁছে দেব।

এর আগের দিন, ৭ অগাস্ট ২০২৫, বৃহস্পতিবার, (২১ শ্রাবণ ১৪৩২), সকালে ঘাটকাজ সম্পন্ন হবে। এই কাজটিও বিবেকনগর কালীবাড়ির পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে সংগঠিত হবে।

এখন, শ্রাদ্ধকার্যের দিন দুয়েক আগে, এই লেখাগুলির তৃতীয় অধ্যায় — "প্রাক–শ্রাদ্ধ অধ্যায়" — লেখা শুরু করছি। অনুমতি দেবেন।

বরফে ঢাকা প্রাকৃতিক পটভূমির সামনে এক মহিলা ও এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। উভয়ের হাতে একটি করে বরফের চাঙর রয়েছে। মহিলা পরেছেন কমলা শাড়ি ও গাঢ় রঙের জ্যাকেট, মাথায় টুপি ও চোখে সানগ্লাস। পুরুষটি রঙিন সোয়েটার ও স্কার্ফ পরা, হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। পিছনে বরফে ঢাকা গাছপালা ও ছোট ছোট বাড়ি। পরিবেশে শীত ও শান্তিময় আবহ।
মা ও আমি। কত বরফ!
শ্রীনগর থেকে ~২০ কিলোমটার দূরে। সোনমার্গের পথে।
৮ জানুয়ারি ২০২০ 

বিশ্বাসে অবিশ্বাস

কথায় বলে "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।" 

বিশ্বাস সর্বজনবিদিত এবং নিরন্তর অনুশীলিত এক অনুভূতি। অপরদিকে, বিশ্বাসই অনেকসময় অত্যন্ত বিভ্রান্তকর এবং প্রবঞ্চনাময় এক ধারনা। এই বিভ্রান্তি এবং প্রবঞ্চনা আত্মকেন্দ্রীক বা নিজের মধ্যে সীমিত হলে তবু ঠিক ছিল। কিন্তু প্রায়শই বিশ্বাস অত্যাচারী, মূর্খ, এবং উন্মত্ত মানুষের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং উন্মাদনা প্রকাশের হাতিয়ার। গত কয়েক শতকের মানব ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা যায়, বোধ হয় এই সময়ের সবথেকে মর্মান্তিক কুকীর্তি হলো নিজের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) অন্যের ওপর বলপূর্বক প্রয়োগ অথবা প্রয়োগের প্রচেষ্টা। ধর্মের নাম, প্রথার নামে, রাজনীতির নামে, সমাজনীতির নামে। রাষ্ট্রের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে। চাপিয়ে দাও। বাধ্য করো। কিচ্ছুটি জানার বা বোঝার দরকার নেই। কেবল "বিশ্বাস" করো।

আমি "বিশ্বাস" করি না (অথবা "বিশ্বাস" করতে চাই না)। যদি আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করেন যে "তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?" উত্তরে আমি বলবো, "দাঁড়ান হুজুর। আপনি তো সরাসরি পরবর্তী স্তর ঈশ্বর–বিশ্বাসে পৌঁছে গেলেন। আমি আসলে এই "বিশ্বাস" জিনিসটাকেই বিশ্বাস করি না।"

বুঝিয়ে বলি। ব্যাঙ্গালোর শহর যে কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত — এই কথা বলতে গিয়ে আমি কি বলবো "আমি বিশ্বাস করি ব্যাঙ্গালোর শহর কর্ণাটকে অবস্থিত?" নাকি আমি বলবো "আমি জানি ব্যাঙ্গালোর শহর কর্ণাটকে?" একই ভাবে, আপনি কি বলবেন যে "আমি বিশ্বাস করি আমার দুটো হাত, দুটো চোখ, একটি নাক আছে?" নাকি আপনি বলবেন "আমি জানি যে আমার দুটো হাত, দুটো চোখ, একটি নাক আছে?" এই অসংজ্ঞায়িত "বিশ্বাস" আসছে কোথা থেকে?

বেশ কয়েকটি বোধ বা অনুভূতি আছে, যেমন প্রত্যাশা, আস্থা, অনুমান, শ্রদ্ধা, এবং সর্বোপরি ভালোবাসা। কিন্তু এই সকল আবেগকে একই সাথে এনে, বা অধিকাংশ সময়ে এই সকল ক্রিয়াগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে "বিশ্বাস" এসে উপস্থিত হয় এবং অনর্থক সব জট পাকিয়ে দেয়।

"বিশ্বাস" হয়তো বা বহুজনের জন্য উপকারী। কিন্তু আমি এই "বিশ্বাস"কে "বিশ্বাস" করা তো দূর কথা, এর সংজ্ঞা, ও পরিধি কী তাই উপলব্ধি করতে পারলাম না। 

"ধর্ম"-এর বিপরীতার্থক শব্দ "অধর্ম"। সঠিক! কিন্তু, "ধর্ম"-এর বিপরীতার্থক শব্দ "জিরাফ"-ও হতে পারে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন "ধর্মে আছো জিরাফেও আছো" নামক। এই কাব্যগ্রন্থের নাম আজ বাংলায় প্রবাদসম! "তাই ধর্ম"-এর বিপরীত শব্দ "অধর্ম"-ও হয়, আবার "জিরাফ–ও হয়।

একই ভাবে, যদি আপনাকে প্রশ্ন করি "জানা" এই শব্দের বিপরীতার্থক শব্দ কী? আপনি বলবেন "জানা" শব্দের বিপরীতার্থক শব্দ? সহজ তো! "না জানা" বা "অজানা"। ঠিক বলেছেন! কিন্তু "জানা"-এর বিপরীতার্থক শব্দ "বিশ্বাস"-ও হতে পারে। এক হয়, আপনি "জানেন", নইলে আপনার কাছে দুটো অপশন থাকতে পারে। একটি হলো আপনি হয় "জানেন না", আর দ্বিতীয়—  আপনি "বিশ্বাস" করেন।

কোনও একটা জিনিস আদৌ হয় কিনা, হলে কীভাবে হয়, কে পুরুষ, কী তাঁর প্রকৃতি — কিছুই জানি না। শুধু, হলে ভালো হতো — আমার অবস্থান বা মতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, হয়তো বা অনেকটা স্বস্তিও পেতাম, এইরকম এক পরিস্থিতিতে বোধ করি "বিশ্বাস" এসে জড়ো হয় আর আঁকড়ে ধরে।

ব্যক্তিগত সান্ত্বনা বা প্রত্যাশা হিসেবে বিশ্বাসের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। কিন্তু না জেনে বিশ্বাস করায় কোথায় যেন একটা দ্বন্দ্ব, একটা সংশয় থেকে যায়। অন্য ব্যক্তিকে তো অর্থক অনর্থক বুঝিয়ে তার ওপরে নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে পারি, বা তাঁকে থামিয়ে দিতে পারি। কিন্তু নিজেকে নিজে "বিশ্বাস" করাই কী করে? 

আমি "বিশ্বাস"-কেই বিশ্বাস করি না।

একজন মহিলা সাদা শাড়ি পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে একটি চক্ষু চিকিৎসালয়, যার সাইনবোর্ডে লেখা আছে 'Dr. Nihar Munsi Eye Foundation'। রাতের আলোয় চারপাশে অল্প আলো-আঁধারি পরিবেশ। রাস্তার ধারে গাছপালা এবং ভবনের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে।
আমার মা, কলকাতার গরচা রোড অঞ্চলে
২৪ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে তোলা ছবি।
আমার মায়ের ছোটবেলার একটা বড় অংশ এই গরচা অঞ্চলে কেটেছিল।
(প্রয়াত) ডাঃ নীহার মুন্সী, যাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এই ছবি তোলা, 
সেই সময় তিনি এই অঞ্চলের এক প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন।

শয়ে শয়ে সংশয়

একটি তৈলচিত্র কল্পনা করুন।

একজন ব্যক্তি — মহিলা অথবা পুরুষ — আপনার ইচ্ছানুযায়ী কল্পনা করতে পারেন। আপনি নিজেকেও ভেবে নিতে পারেন। নৈসর্গিক পরিবেশ; আবহ কুজ্ঝটিকাময়। যদিও পারিপার্শ্বিক অস্পষ্ট, তবু তা নানা উজ্জ্বল–অনুজ্জ্বল রঙে পরিপূর্ণ। আবিরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে সব রঙ। 

সেই ব্যক্তি দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা শক্ত করে ধরে বসে আছেন — যেন খুব ব্যাথা করছে। সাথে সাথে তিনি যেন হাতের মুঠো দিয়ে নিজের মাথার চুলগুলো টানছেন। মনের মধ্যে অনেক কথা নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে ঘুরে উড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক শব্দ — ভিতরে বাইরে। অনেক জোরে আওয়াজ। 

সেই ব্যক্তির খুব কষ্ট হচ্ছে। চারিদিকের এত হুল্লোড় বড় ধাক্কা দিচ্ছে। কত মানুষ। কত স্বর। সবাই চিৎকার করে নিজের মতামত, নিজের "বিশ্বাস" উগড়ে দিচ্ছেন। কত রকম ধ্যান ধারনা, কত রকম পরিচিন্তন। আর সবাই দেখি বুক বাজিয়ে দাবী করছেন, "আমার কথাটাই ঠিক। আমার পথে হাঁটলেই পৌঁছনো যাবে গন্তব্যে। আমার কথা শুনলেই মিলবে ঠিকানা"। 

মানুষটি আর সহ্য করতে পারছেন না। তিনি পারছেন না তাঁর ছোট্ট একটি মনে এই এত বাক–বিতণ্ডা, সুবিশাল জগৎ–সংসারকে ধারণ করতে। চারিদিকে রাশি রাশি নীল–কালো–খয়েরী "বিশ্বাস" যেন নরকের প্রহরীর মতো হাতে ছুঁচালো শূল নিয়ে খোঁচানোর জন্য তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বস্তু এক — তার প্রতি অভিমত সহস্র। ব্যক্তি একাকী — তাঁর প্রতি সমালোচনা অনন্ত। খুব যন্ত্রনা হচ্ছে।

শয়ে শয়ে সংশয়। মনের মাঝারে অনেক সংশয় বাসা বাঁধে।

কেউ বলে বস্তুবাদ, তো কেউ বলে অধ্যাত্মবাদ। কেউ বলে সমাজবাদ, তো কেউ বলে প্রগতিবাদ। 

কোনও এক ধর্ম হাজার বছর ধরে মানুষের মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম দাবী করে আসছে। অপর দিকে অন্য আরেক ধর্ম এই পুনর্জন্মতত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে বলছে মৃত্যুর পর মানুষ 'বারযাখ' বা অন্তর্বর্তীকালীন জীবনে প্রবেশ করে। তারপর নাকি কেয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হয়ে তাঁদের কর্মফল অনুসারে জান্নাত বা জাহান্নাম-এ যায়।

এইটুকুতে শেষ হলেও হতো! কিন্তু না। রক্তাক্ত ছুরি হাতে ছাগলের নরম পেট চিরতে চিরতে কসাই শোনায় জীবপ্রেম আর অহিংসার বাণী! দামী বিদেশী স্কচের পেয়ালা হাতে নিয়ে সাম্যবাদী কোনও নেতা সর্বহারাদের ব্যাথা–বেদনা নিয়ে লেকচার দেন! চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি সততার পাঠ শেখান! নিজে যিনি ধর্ষক এমন ব্যক্তিও "তিলোত্তমা কাণ্ডে" "We want justice" (#WeWantJustice) লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেন এবং লাইকস–বাহবা আদায় করেন! 

আমাদের যে কোনও প্রথাতেও — অন্নপ্রাশন হোক বা উপনয়ন, বিবাহ হোক বা শ্রাদ্ধ — মনের মধ্যে অনেক সংশয় দাপিয়ে বেড়ায়।

বুঝলে নন্দলাল? ডান হাতে ঘটি ধরো, বাম হাতে বাটি! অনামিকায় কুশাঙ্গরীয় পরো! বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নীচের দিকে রেখে পাত্রে জল ঢালো! ... আচার আচরণের চোটে আপনি অস্থির হয়ে উঠবেন।

এক দলা ভাত বা চাল, কোনোমতে তিল দিয়ে মাখা — যেই দলাটা আপনি বা আমি নিজেই খেতে পারবো না এবং খাওয়ার কথা ভাববোও না, সেইটা সব দেবতা আর পূর্বপুরুষদের প্রতি উৎসর্গ করে চলেছি! যজ্ঞে—বিবাহে প্রার্থনা করছি আমাদের শস্যক্ষেতে যেন প্রচুর ফসল হয়! আমাদের গরুগুলো যেন প্রচুর দুধ দেয়! কিন্তু, আরে দাঁড়ান হুজুর, আমার নিজের না আছে ধানক্ষেত, না আছে গোয়াল ভরা গরু! তাহলে আমি প্রার্থনা করছিটা কী?

আত্মা কী তারই সংজ্ঞা খুঁজে পেলাম না। সেই আত্মা নাকি আবার দেহ ছেড়ে যাবার পর প্রিয় মানুষের ধারে কাছে ঘুরে বেড়ায়! আয়, আয়, আয় বলে ডাক দিয়ে যায়! অনেক জায়গায় দেখেছি, বলে, বড় করে আচার অনুষ্ঠান করলে (অথবা সহজ করে বলতে গেলে প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করলে) নাকি এই আত্মার মুক্তি হয়। আত্মা কী, তার বিন্দুমাত্র বুঝলাম না, তার ওপর মহাকাব্য রচিত হয়ে গেল। বুঝলে দেবদুলাল?

শুধু বাইরে কোলাহল হলে তবুও হতো। আপনার মনের মধ্যে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণহীন চিন্তা, প্রবৃত্তি, এবং এমনকি আপনার জেনেটিক মেমোরি বা বায়োলজিক্যাল টেন্ডেন্সি, আর আপনার অতীত জীবনের কিছু ছেঁড়া কালো স্মৃতি আপনাকে অহরহ তাড়া করে বেড়াবে।

আপনার পালানোর পথ নেই। যেখানেই যান, তীর, বল্লম, বর্শার মতো শয়ে শয়ে "বিশ্বাস" আর মতাদর্শ, আলোচনা, সমালোচনা, উপদেশ, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ, পরামর্শের রূপ নিয়ে আপনার দিকে ছুটে আসবে। অন্যদিকে, আপনার অবচেতন মন আপনাকে তুর্কি নাচন নাচাবে। 

একজন মানুষের মুখমণ্ডল এবং দেহ দুইভাগে বিভক্ত। একজনের অর্ধেক অংশ নারী, অর্ধেক অংশ পুরুষ। তিনি চুলের মুঠি ধরে কষ্টে চিৎকার করছেন। পিছনে বর্শা ও মুখোশ পরা নানা বিভীষিকাময় মুখের আক্রমণাত্মক অবয়ব চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে। চারিদিকে নানা উজ্জ্বল ও গাঢ় রঙের ছিটেফোঁটা। এই চিত্র মানসিক যন্ত্রণার প্রকাশ।
কত হুল্লোড়, কত কোলাহল!

সমালোচনা উদ্দেশ্য নয়!

এইরকম অবস্থায় আগামী ৮ অগাস্ট ২০২৫ (২২ শ্রাবণ ১৪৩২) আমি আমার মায়ের শ্রাদ্ধকার্য করতে চলেছি। দেখুন কোনও বৈদিক রীতি বা অন্য ধর্ম যেমন ইসলামের বয়ান — এই সকল কিছুর সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কমিউনিসম বা ডেমোক্র্যাসির ভুল–ভ্রান্তি ধরতে আসিনি। 

হয়তো আরও মননশীল হলে বুঝতে পারবো যেই সকল প্রথা বা আচরণের কথা বলছি, তার মধ্যে হয়তো গভীর কোনও অর্থ বা রূপক আছে। অথবা, অতীতে তার কোনও অর্থ এবং উপযোগিতা ছিল। 

এক সময়ে সব মানুষ হয়তো ধুতি জাতীয় পোশাক পরতেন, তাই তাঁরা পুজো–অর্চনা–যজ্ঞ সেই ধুতি পরেই করতেন। সেইসময় অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট, বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন, ভিসিটিং বা গলায় ঝোলানো কোনও আইডেন্টিটি কার্ড ছিল না। তাই কিছু বিদ্বান মানুষ তাঁদের জ্ঞান ও যোগ্যতার পরিচায়ক হিসেবে হয়তো কাঁধে গলায় পৈতে ঝোলাতেন। হজরত মহম্মদ এবং তাঁর অনুরাগী ভক্তবৃন্দরা নানা অনুষ্ঠানে প্রচুর খেজুর খেতেন। এর একটা কারণ বোধ করি খেজুরই তাঁদের কাছে সহজলভ্য ছিল, অন্যান্য বিবিধ ফল হয়তো হাতের কাছে সহজে সবসময়ে পাওয়া যেত না। 

এইরূপে নানা রীতিনীতির বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা ও অতীত উপযোগিতা খুঁজলে কার্য–কারণ বোঝা যেতে পারে বোধ হয়। কিন্তু, যতদিন না জানছি, যতক্ষণ না বুঝছি, কোনও অ্যাবস্ট্রাক্ট ধ্যান–ধারনার ওপর বিশ্বাস করি কেমন করে? 

এইটি কার তৈলচিত্র?

শেষ করার আগে একটা প্রশ্ন করি। এই অধ্যায়ের "শয়ে শয়ে সংশয়" অংশে যেই ব্যক্তির কল্পনা করতে বলেছিলাম, সেইটি আসলে কার চিত্র ছিল? 

সততঃ এবং স্পষ্টতঃ এই চিত্রিত ব্যক্তির মধ্যে আমি নিজেকে দেখতে পাই। এবং আমি আমার মা–কেও একই ব্যক্তি হিসেবেই খুঁজে পাই।

এত শব্দ, এত আওয়াজ! নিজে না জেনে "বিশ্বাস" আর নিজে না মেনে "আচরণ" অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। এবং তা না মানতে পারলেই সমালোচনা, বিদ্রূপ, তিরস্কার, পর্যালোচনা। সম্ভব হলে সেই ব্যক্তির অস্তিত্বকেই নাকচ করে দাও! ক্ষতি কী? চিত্রিত ব্যক্তির মধ্যে আমার মাকে, নিজেকে এবং আরও অনেক মানুষকে দেখতে পাই।

আমার মায়ের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে "কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট" বা "হার্ট অ্যাটাক"–এর কথা লেখা আছে। কিন্তু আমি আপনাকে গোপনে বলি শুনুন, এই চারিদিকে, ভিতরে–বাইরে এই উপদ্রব, এই হুজ্জতি, এই হুল্লোড়–কলরব বহু দিন ধরেই আমার মাকে ধীরে ধীরে ক্ষইয়ে দিচ্ছিল। আমার ভিতরটাও ক্ষইয়ে দিচ্ছে। এবং, হয়তো বা আপনারও।

আপাততঃ সামনে মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। সেই কাজ যতটা সম্ভব ভালো ভাবে করার চেষ্টা করবো। এই তৃতীয় অধ্যায় — "প্রাক–শ্রাদ্ধ অধ্যায়" এইখানেই শেষ করলাম।

চরৈবেতি!

দ্রষ্টব্য: এই তৃতীয় অধ্যায়ের একটি সংযোজন অংশ রয়েছে।

স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)


This page was last updated on: 8 August 2025
Number of revisions on this page: 3
Internet Archive Backup: See here 

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.