Sunday, August 03, 2025

স্বপ্না দত্ত, আমার মা: দ্বিতীয় অধ্যায়

আজ আমি ফেরিওয়ালা। এসেছি পসরা নিয়ে। ভালো ভালো জিনিস আছে। আছে এক স্বচ্ছ আয়না। এই আয়নাটি দেখাতেই এসেছি। দেখবেন নাকি? দেখতে তো কোনও বাধা নেই, আর দেখলেই যে ক্রয় করতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। 

আসুন, তবে আরম্ভ করা যাক।

কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া

"কিচ্ছু চাইনি আমি
আজীবন ভালোবাসা ছাড়া।
আমিও তাদেরই দলে
বারবার মরে যায় যারা।
না, না, কিচ্ছু চাইনি আমি,
আজীবন ভালোবাসা ছাড়া..."
গীতিকার: দীপাংশু আচার্য

অনুগ্রহ করে লক্ষ্য করুন, গানের এই অংশে এক করুণ অদম্য চাহিদার কথা ফুটে উঠেছে। আমি নিশ্চিত যে এই আকুতি, এই চাহিদা কোনও একক ব্যক্তি বা বিশেষ ব্যক্তিবর্গেরই মনের কথা নয়। প্রায় সুনিশ্চিতভাবেই বলতে পারি এই আকুতিটি সকল মানব মনের সংগোপনে লুকিয়ে রাখা স্বর।

রামপ্রসাদ সেন লিখেছিলেন "এমন মানব–জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা, মনরে কৃষিকাজ জানো না।" আর এই মন, যে কৃষিকাজ জানে না, তাকে শক্ত করে নিংড়ে যখন দেখি, বুঝতে পারি সারাটা জীবন আমি আর কিচ্ছু চাইনি, শুধু একটুমাত্র ভালোবাসা ছাড়া। যত চিন্তা, যত কথা, যত বোধ, যত ব্যথা— প্রতি পদক্ষেপ, প্রত্যেকটি উদ্যোগ— এই সকল কিছুর শুরু থেকে শেষ অবধি ছিল এবং আছে শুধু এই এক চিন্তা, একই প্রত্যাশা। যা করেছি, যা করিনি, যা করতে গিয়ে ভুল করেছি, যা আরও ভালোভাবে করতে পারতাম — সেই সকল কিছুর চালিকাশক্তি এবং আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ছিল একটিই — আর কিছু না, শুধু কিছুটা ভালোবাসা।

জীবনানন্দ দাশ তাঁর "নির্জন স্বাক্ষর" কবিতায় তো স্পষ্ট করে বলেছিলেনই — "তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে। যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’, পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?"

জানেন, বহুবার এমন হয়েছে যে একটি বিশেষ কোনও গান শুনে নির্ধারণ করতে অসুবিধা বোধ করেছি যে সেইটিকে কি ঠিক প্রেমের গান বলা উচিত, না ধর্মীয় সঙ্গীত। ধরুন কোনও সুফি গান, শ্যামাসঙ্গীত, গজল, রবীন্দ্র সঙ্গীত, প্রভাত সঙ্গীত, গুরুগম্ভীর সংস্কৃত স্তোত্র, বা চলচ্চিত্রের কোনও জনপ্রিয় প্রেমের গান। লক্ষ্য করে দেখবেন, বহুলাংশে ধর্মীয় প্রার্থনা সঙ্গীত এবং ভালোবাসার আবেগপ্রবণ গীত মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে যায়। গঙ্গার জল উপচে ছলকে পড়ে যমুনাতে। সেই একই স্বর, একই সুর, একই ভাষা, একই আবেগ, একই অভিব্যক্তি। বিষয়শ্রেণী এবং বর্গীকরণ হয়ে ওঠে অহেতুক এবং অনর্থক।

এই যে মনোবীণার ঝংকার, এই অনুসন্ধিৎসা, তা তো শুধু আজকেরই তো নয়। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য আজ থেকে দুই শতকেরও আগে নিজের গানে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন— "পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসেনা, এ' পৃথিবী ভালোবাসিতে জানেনা, যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি, সেথা যেতে প্রাণ চায় মা।" 

ভালোবাসার এই অন্বেষণ, তার এই স্বর চিরন্তন — সার্বজনীন। Man's Eternal Quest. ওপরের অনুচ্ছেদগুলিতে কিছু উদাহরণ ও বর্ণনা দিয়েছি। আমি নিশ্চিত আপনি এতে আরও বহু সংযোজন করতে পারবেন। যুগে যুগে, কালে কালে, সকল স্থানে আপনি শুনতে পাবেন এই ধ্বনি। আপনি বাহির পানে চোখ মেললে বাইরে খুঁজে পাবেন। আর ডুব ডুব ডুব, রূপ সাগরে আমার মন বলে ডুব দিলে, নিজের মনের মধ্যেও হয়তো খুঁজে পাবেন এই একই অনুরণন, এই একই নাদ।

একজন মহিলা, হলুদ শাড়ি ও লাল সোয়েটার পরা, সবুজ ওড়না গলায়, সূর্যের আলোতে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে একটি মন্দিরের প্রাঙ্গণে লাল শাড়ি পরা দশভুজা দেবী দুর্গার মূর্তি দেখা যাচ্ছে।
আমার মা, স্বপ্না দত্ত, রামকৃষ্ণ মঠ, কামারপুকুরের নিকটে
১৩ই জানুয়ারি ২০২০ তারিখে তোলা ছবি

২৭ জুলাই ২০২৫: প্রয়াণ দিবস 

আমার মা স্বপ্না দত্ত গত ২৭ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার, রাত ১১টা ২৫ মিনিটে এম. আর. বাঙ্গুর হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা গেছেন। 

মা এই বছরেরই ২৪ জুন থেকে ৪ জুলাই কে. পি. সি. মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অল্প কয়েক দিন পরেই ২১ জুলাই থেকে ২৬ জুলাই দ্বিতীয়বারের জন্য একই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন।

কে. পি. সি. মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে প্রথমবার

২৪ জুন, মঙ্গলবার, মাকে কে. পি. সি. মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তির পর সিটি স্ক্যান, এম. আর. আই. স্ক্যান, ই. ই. জি., ইউ. এস. জি. ইত্যাদি নানা পরীক্ষা হয়। কিছু ছোট ছোট ব্রেন স্ট্রোক পাওয়া যায়, এইছাড়া আরও কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল। ৪ জুলাই, শুক্রবার, ডিসচার্জ হওয়ার পরও মা অসুস্থ ছিলেন। আস্তে আস্তে কিছুটা সেরে উঠছিলেন। 

কে. পি. সি. মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দ্বিতীয়বার

২০ জুলাই, রবিবার, দুপুর থেকে মাকে প্রায় কিছুই খাওয়াতে পারছিলাম না। অর্ধতরল খাবার খাওয়াতে গেলেও যেন গলায় আটকে যাচ্ছিল বা মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল। এর আগে ১৮ জুলাই, শুক্রবার, শেষরাত থেকে পুরো ১৯ জুলাই মা প্রায় ঘুমোতেই পারেননি। ডাক্তারের নির্দেশমতো ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ঘুম তেমন হয়নি। ২১ জুলাই ২০২৫, সোমবার, সকালে মাকে কে. পি. সি. মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে দ্বিতীয়বার ভর্তি করাই। মূলতঃ ইউরোসেপসিস এবং আর কিছু সমস্যা পাওয়া যায়। মা ২১, ২২, ২৩ জুলাই কে. পি. সি. হাসপাতালের আই. সি. ইউ. ওয়ার্ডে ছিলেন। ২৪শে জুলাই দুপুরে মাকে ওই হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ২৬শে জুলাই, শনিবার, বিকেলে, মাকে যখন হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা তখনও মা বেশ অসুস্থ। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো হাসপাতালে হুইলচেয়ারে করে নামাতে পারা যাবে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ডিসচার্জের সময় মাকে ট্রলিতে করে হাসপাতালের তিনতলা থেকে নীচে নামানো হয়। ডিসচার্জের সময় মায়ের শরীর ভালো ছিল না। 

এম. আর. বাঙ্গুর হাসপাতাল

২৭ জুলাই, রবিবার, দুপুর থেকে মা আবার বেশ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। না পারছিলাম মাকে উঠে বসাতে, না পারছিলাম তেমন কিছু খাওয়াতে। ল্যাক্টোস ফ্রি দুধ কিছুটা এনে রেখেছিলাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মাকে শোওয়া অবস্থায় কিছুটা দুধ খাইছিলাম, যেইটা মা ঢোক গিলে খেতে পেরেছিলেন। রাত নয়টা নাগাদ অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এইবার আর কে. পি. সি. হাসপাতাল নয়। আমার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। আর দ্বিতীয়বারের কে. পি. সি. হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ, মানে ঠিক আগের দিনই, আমার ব্যক্তিগতভাবে হয়তো আকস্মিক ডিসচার্জ মনে হয়েছিল।

মাকে নিয়ে গেলাম এম. আর. বাঙ্গুর সুপারস্পেশালিটি (সরকারী) হাসপাতাল। বাঙ্গুর হাসপাতালে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে রাত ২৭ জুলাই ২০২৫, রাত ১০টার সময় যখন ডাক্তার নিরীক্ষণ করছেন, তখন মায়ের— 
  • রক্তচাপ ছিল ১৩৮/৮৪; 
  • রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ৯৮%; 
  • পালস রেট ছিল ৮২; আর
  • রক্তশর্করা ছিল ২৩২ mg/dl
যদিও এইসময় মা কথা বলছিলেন না। তাকিয়ে ছিলেন, অল্প অল্প সাড়া দিচ্ছিলেন। তবে সেই সাড়া সুস্পষ্ট নয়।
পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দপ্তরের একটি ইমার্জেন্সি রোগীর ফর্ম।
এম. আর. বাঙ্গুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের নথির প্রতিলিপি
২৭ জুলাই ২০২৫, রাত ১০:০১
মাকে পরীক্ষা করার পর ডাক্তারবাবু হাসপাতালে ফিমেল ওয়ার্ডে ভর্তি করানোর নির্দেশ দেন। ফর্ম ফিল, ভিজিটিং কার্ড তৈরির কাজ করা হয়। ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার আগে মাকে হাতে চ্যানেল করে দুয়েকটি ইনজেকশন দেওয়া হয়, আর স্যালাইন চালু করা হয়। মায়ের হাতের শিরা খুঁজে পেতে একটু সমস্যা হয় বলে এই হাতের চ্যানেল করতে সামান্য একটু সময় লেগেছিল। 

আমাকে বলা হয় মাকে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের ঠিক পাশে ই. সি. জি. ঘরে নিয়ে গিয়ে ই. সি. জি. করিয়ে নিতে। আর তারপর বোধ হয় সিটি স্ক্যান হওয়ার কথা ছিল। ই. সি. জি. ঘরে মাকে নিয়ে গিয়ে যখন অপেক্ষা করছি, ট্রলিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় মায়ের শরীরে খুব সামান্য একটা কাঁপুনি লক্ষ্য করি। আর বোধ হয় প্রায় তার ঠিক পরেই মায়ের মুখ থেকে কেমন ফেনা বা বাবল বেরোতে শুরু করে।

প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। খাবার বা জল খাওয়াতে গিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার মায়ের মুখ থেকে খাবার বেরিয়ে এসেছে। আমি হাত দিয়ে মুখের ফেনা অল্প একটু মুছিয়ে দিতে যাই। হঠাৎ আমার কেমন যেন ভয় করে। কাছে একজন নার্স ছিলেন, আমি তাঁকে বলি, "ম্যাডাম দেখুন মায়ের মুখ থেকে কেমন ফেনা বের হচ্ছে।" সেই নার্স আমাকে বলেন, "আপনি তাড়াতাড়ি যান ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসুন।"

আমি সাথে সাথে পাশের ইমারজেন্সি রুমে গিয়ে অফিস কাউন্টারে ডাক্তার পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাই। ইমারজেন্সি রুমে খুব ভিড় ছিল। ডেস্কে বসা একজন নার্স দ্রুত ব্যবস্থা করে বললেন, "আপনি পেশেন্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ান, ডাক্তার বসু এখনই যাচ্ছেন।" 

সেই শুনে আমি ই. সি. জি. ঘরের দরজার কাছে অপেক্ষা করতে থাকি। প্রায় ১–২ মিনিট পরেও যখন ডাক্তারবাবু আসছেন না, আমি আবার পাশের ইমারজেন্সি ডেস্কে যাই। সেই একই নার্সকে বলি, "ম্যাডাম ডাক্তারবাবু তো এলেন না।" 

মাত্র এক বা দুই মিনিট অপেক্ষা সরকারী বা বেসরকারী, যে কোনও হাসপাতালেই, খুব একটা বিশাল প্রতীক্ষা নয়। তবু আমার সেই অপেক্ষাটুকু তখন সহ্য হচ্ছিল না।

আমি যখন দ্বিতীয়বার ইমারজেন্সি ডেস্কে গেছি, নার্স তখন রেকর্ড খাতায় কিছু একটা লিখছিলেন। আমার কথা শুনে উনি সাথে সাথে হাতের কাজ বন্ধ করে একজন মহিলা ডাক্তারকে বলেন, "ম্যাডাম, আপনি এখনই এনার পেশেন্টেকে একবার দেখতে যান।" আর তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "আপনি এই ডাক্তার ম্যাডামের সাথে সাথেই যান।"

ডাক্তার ম্যাডাম আর আমি দ্রুত ই. সি. জি. ঘরে পৌঁছে যাই। আমার মায়ের মুখ দিয়ে ফেনা বেরোনোর সময় থেকে এই সময় অবধি বড়জোর ৫–৭ মিনিট সময় কেটেছিল। 

ডাক্তার ম্যাডাম সামান্য কিছু পরীক্ষা করে আরেকজন ডাক্তারকে ডেকে আনেন। দুইজন মিলে মায়ের কিছু পরীক্ষা করতে থাকেন। কয়েক মিনিট পরে ডাক্তার ম্যাডাম আমাকে ই. সি. জি. রুমের বাইরে ডাকেন। সেইখানে তিনি আমাকে বলেন, "দেখুন একজন মানুষের যেই সকল জীবনের চিহ্নগুলি থাকে, তার একটাও আমরা আপনার মায়ের শরীরে এখন পাচ্ছি না। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমরা একটা ইনজেকশন দিয়ে থাকি, সেইটা আমরা এইমাত্র দিয়ে দিলাম। আমরা এখন মিনিট ১৫ অপেক্ষা করবো। আপনি মনকে বোঝান, আপনার মা আর নেই!"

মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন

আমার মা ছিলেন মা কালীর ভক্ত। অপরদিকে আমার বাবা তরুণ দত্ত (প্রয়াণ ৪ মে ১৯৯৮) ছিলেন মা তারার ভক্ত (মা কালীর আরেক রূপ)। বাবা যখন মারা গেছেন তখন আমার বয়স ১০। খুব বিস্তারিত মনে নেই। কিন্তু আমার মায়ের কথা স্পষ্টতই মনে আছে। 

"মা। মা কালী মা।" আমার মা জপ করতেন। মা কালীর কাছে আমার মা প্রার্থনা করতেন, "আমার টিটোকে নীরোগ করো, সুস্থ করো, মানুষ করো।" আমার বয়স এখন ৩৭। আমার নিজের ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মা বছরের পর বছর এই একই প্রার্থনা করে আসছেন। ঠিক এই শব্দগুলো।

আমার মায়ের একটি খুব প্রিয় গান ছিল—

"মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন,
আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন।
তার গন্ধ না থাক যা আছে সে নয় রে ভুয়ো আভরণ,
গন্ধ না থাক, (ও তার গন্ধ না থাক) যা আছে সে নয় রে ভুয়ো আভরণ।
জানি জুঁই মালতী হায়, কত গন্ধ যে ছড়ায়,
তবু ঘরের ফেলে পরের কাছে নিজেরে বিলায়।
ওরে তোর মতো যে নেই কো তাদের মায়ে পোয়ে আলাপন
আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন। ..."

একটা ঘটনা বলি। আমার বয়স তখন ৭–৮। সাল হয়তো বা ১৯৯৬। হালতু অঞ্চলে ছোট এক কামরার ভাড়া ঘরে থাকি। একটা ছোট খাটে রাতে মা আর আমি শুতাম। ঘরের অন্য পাশে আরেকটা ছোট খাটে বাবা শুতেন। মায়ের সাথে কত কথাই না হত সেই সময়ে। একটা কথা মনে পড়ে, মা আমাকে রূপকথার মতো করে বলতেন— "একদিন আমরা একটা ঘর করবো, যাতে দেওয়ালে একটা স্যুইচ থাকবে। দেওয়ালের সেই স্যুইচ টিপলেই ঘরের ছাদটা সরে যাবে। তুই আর আমি তখন এই খাটে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখবো। তারাভরা আকাশ দেখবো" 

এই চিন্তা যে খুব একটা বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা আমি সেই সময়ে একদমই ভাবিনি। মায়ের সাথে আমিও তখন এই দৃশ্য কল্পনা করতাম। মাথার ওপর খোলা আকাশ, রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা। কল্পনা করতে ভালো লাগতো।

আর সেই মহিলার মৃত্যু হলো সরকারী হাসপাতালের ভিড়ে ভর্তি একটি ঘরের বারান্দার সামনে! ট্রলির ওপর শোওয়া অবস্থায়, ই. সি. জি. পরীক্ষার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়!

ধান ভানতে শিবের গাজন

Woman in blue sari standing by multilingual wall with "#iamcourage" written below.
ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল মিউসিয়াম, দিল্লি
২১ নভেম্বর ২০১৭। 
আপনি যদি আমার মায়ের সম্পর্কে লেখার প্রথম দুই অধ্যায় দেখেন, আপনার মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমি ধান ভানতে গিয়ে অনেকটা শিবের গাজন গাওয়া শুরু করেছি। প্রথম অধ্যায়ে বলেছিলাম "বিভেদ" নিয়ে, আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে অনেকটা বলেছি "অন্বেষণ" নিয়ে। আমার মনে হয় এইটি প্রয়োজন ছিল, এবং এখনও প্রয়োজন আছে। আর তা ছাড়া অন্নপূর্ণা তো ঈশ্বরী পাটনীকে তো বলেছিলেনই— "বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি।"

এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে একটা বড় অংশ জুড়ে যে ভালোবাসার খোঁজ, অন্বেষণ, এই নিয়ে যা লিখেছি বা যা যা উদ্ধৃতি দিয়েছি, আজ, এখন তাকিয়ে দেখলে স্পষ্টতঃ বুঝতে পারি, বিমূর্ত এই সকল আবেগ আমার মায়ের মননে এবং জীবনে উজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত ও মূর্ত ছিল। এবং তা ঘিরেই সব কাজ, কথা, ঠিক আর ভুল ভ্রান্তি।

"কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া। আমিও তাদেরই দলে বারবার মরে যায় যারা" — এই কথা আমার মায়ের জন্য বিশেষ প্রযোজ্য।

এইখানেই এই লেখাটি শেষ করতে পারতাম। তবে... দাঁড়াও পথিকবর... তিষ্ঠ ক্ষণকাল।

এই যেই কথাগুলি বললাম, তা কি শুধু আমার মায়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? লেখার শুরুতে বলেছিলাম, আমি আজ ফেরিওয়ালা হয়ে একটা আয়না নিয়ে এসেছি। একটিবার নিজের মনের মধ্যে ডুব দিয়ে দেখুন তো। হয়তো বা আপনার নিজের মনের মধ্যেও একই আকাঙ্ক্ষা, একই আকুতি, একই চাহিদা খুঁজে পাবেন। আর এইটাই ছিল সেই আয়না যেইটা আপনাকে দেখাব বলেছিলাম।

দ্বিতীয় অধ্যায় আপাততঃ এইখানেই শেষ করছি। 

চরৈবেতি।

স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)


This page was last updated on: 3 August 2025
Number of revisions on this page: 2
Internet Archive Backup: See here

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.