Tuesday, October 07, 2025

আমরা কি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছি?

একটা প্রশ্ন প্রায়শই মনের মধ্যে এসে ঘুরপাক খায়, সবসময় ঠিক প্রশ্ন হিসাবেই নয়। কখনো অনুভূতি হিসাবে, কখনো অভিজ্ঞতা হিসাবে, কখনো বা বোধ হিসাবে। আমরা কি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছি? এখানে "আমরা" বলতে মানবসমাজ — সমষ্টিগতভাবে এবং ব্যক্তিগত — দুজনেরই কথা বলছি। 

সভ্যতার ভার

২০২৫ সাল চলছে। আমাদের মানবসভ্যতার বয়স অন্তত কয়েক হাজার বছর। এইটা শুধুমাত্র বর্তমান সভ্যতার বয়স। মানবসভ্যতার সকল স্তরগুলি, যেমন প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ, আমাদের সভ্যতার বয়স আরও অনেক বেশি। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে, আমরা, সমষ্টিগতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে বড্ড বেশি ভারাক্রান্ত, এবং ক্লান্ত হয়ে উঠছি। এইটা যে হঠাৎ করে এই বছরেই হচ্ছে, এমন নয়। বহু বছর ধরেই এই ক্লান্তি, এই ভারের বোঝা ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে।

আমাদের কাছে রয়েছে শত–সহস্র মনীষী–বিদ্বান। শত–সহস্র তাঁদের মত–পথ। শয়ে শয়ে ধর্ম, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী। 

বই মানবসভ্যতার সবথেকে নির্ভরযোগ্য জ্ঞান আহরণের মাধ্যম। আপনি চোখ মেলে তাকান, লাখ লাখ বই লেখা হয়ে গেছে। যদি শুধু সেরা বইগুলোকেও বাছতে হয় (কিসের নিরিখে কে বাছবে জানি না) , তবু সংখ্যাটা নির্দ্বিধায় অনেক হাজারে পৌঁছে যাবে। আপনি সব কাজ ছেড়ে সারাদিন পড়লেও, সারা জীবনে খুব সামান্যই পড়তে পারবেন।

শুধু বই নয়। অন্যান্য সকল মাধ্যম— সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, সবকিছুতেই সংকলনের আকার অত্যন্ত বড়।

একটা ২,০০০+ বছরের সভ্যতায় এইটা হয়তো খুবই স্বাভাবিক। আমাদের কাছে আমাদের অতীতের জ্ঞান–বিদ্যা–তথ্য–শিল্প–সাহিত্য রয়েছে। এর একটা খুব সুবিধার জায়গা হলো, যেইটা আইজাক নিউটন বলেছিলেন—  "If I have seen further, it is by standing on the shoulders of giants." ("যদি আমি আরও দূরে দেখতে পেয়ে থাকি, তবে তা মহান ব্যক্তিদের (দৈত্যদের) কাঁধে দাঁড়ানোর ফল।") সভ্যতা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। ছাপাখানা, বিদ্যুৎ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, এবং বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবসভ্যতাকে নতুন নতুন স্তরে পৌঁছে দিচ্ছে। আমরা সত্যিই দৈত্যের মতো বিশাল সভ্যতার কাঁধে দাঁড়িয়ে আছি। তবে, এর একটা অপর দিকও আছে, বোধ হয়। এই সব কিছুর, এই এত মত–পথ–মতাদর্শের একটা ভার আছে, একটা বোঝা আছে। এই বিশাল বোঝা আমাদের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে ক্লান্ত করে তুলছে। 

শিল্প বিপ্লবের সময়কালের একটি কার্টুন চিত্র, যেখানে ১৯ শতকের কারখানার পরিবেশে ক্লান্ত নারী ও পুরুষদের ভিড় দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ধনী, দরিদ্র ও অতি দরিদ্র সব শ্রেণির মানুষ রয়েছে। আকাশের রং হালকা নীল, সবুজ, নীল ও ধূসরের মিশ্রণ। চিত্রটিতে অনেক চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং কিছু মানুষ সামনে রিং-এ হাঁটছে, আর একজন ধনী মহিলা তাদের মধ্যে প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আমরা হয়তো অত্যন্ত ভারাক্লান্ত হয়ে উঠছি।

দুইখানা জিনিস যা হয়নি

অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। দেখুন, দুইখানা জিনিস হয়নি। সেই বিষয়ে সংক্ষেপে বলি। 

আমাদের জীবন মোটেও সহজ হয়নি

প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানবজীবন আরও সহজ হয়ে ওঠা উচিত ছিল। এইটা হয়নি। জীবন আরও বেশি জটিল হয়ে উঠছে। ভালোভাবে বেঁচে থাকার সবকিছু আপনাকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ভ্রমণ, বিনোদন — সবকিছুর যা দাম! একটা শিশু জন্মেই যদি দেখে তার ছোট থেকে যুব বয়স অবধি পৌঁছতেই, মানে শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করতেই, বহু লক্ষ টাকা প্রয়োজন হবে, তবে এই জীবন মোটেই সরল নয়। এর পরেও লেগে থাকবে আরও হাজার খরচ আর আরও নানা সমস্যা। আমাদের সভ্যতার বয়স অনেক, তবে তা মোটেও আমাদের জীবনকে সহজ করেনি। বরং বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত দামী এবং নাগালের বাইরে করে দিয়েছে। এইটা আমাদের সভ্যতার একটা বড় ব্যর্থতা। 

আমাদের মন অন্ধকারমুক্ত হয়নি

এই কথাটা কিছু জায়গায় শুনেছি, এবং আমি এর সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করি। আমাদের যা উন্নতি হয়েছে, প্রায় সবই বাহ্যিক। আকাশচুম্বী অট্টালিকা, আকাশে ড্রোনের মেলা, সুপারফাস্ট কম্পিউটার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা — সবই বাহ্যিক। আমাদের মনের ভিতরে নানা রিপু— লোভ, ঘৃণা, স্বার্থপরতা — কয়েক হাজার বছর আগে বা আদিম যুগে যা ছিল, তাই আছে। আমাদের মনের ভিতরের অন্ধকার কমেনি। যা ছিল, তাই আছে।

মনের এই অন্ধকার প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজে এবং আচরণে প্রকাশ পায়। খুঁজতে হবে না, সবকিছুতেই দেখা যায়। ইন্টারনেটের একটা খুব বড় অংশ পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান (২০২৪–২০২৫) অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট ডেটা ট্রান্সফারের ৩৫%-এর মতো অংশই পর্নোগ্রাফি। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নানা কাজ চলছে। বোধ করি, সবশেষে দেখা যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতার একটা বড় অংশের প্রয়োগ পর্নোগ্রাফি জাতীয় বিষয়েই হবে।

ভারলাঘবের সন্ধানে

এই ভার — এই ক্লান্তি শুধু আজকের নয়, বহু বছর ধরে দিন দিন ক্রমে বেড়ে চলছে। এবং একই সাথে চেষ্টা চলেছে ভার লাঘবের। সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ সমাধান, ধর্মীয় হোক বা রাজনৈতিক মতাদর্শগত, একটা সময়ের পর ভার লাঘব না করে, নিজেই বড় ভার হয়ে বসেছে। একটা সময়ের পর যেইভাবে কোনও ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ যেইভাবে প্রচলিত হয় এবং চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার সাথে মূল মতাদর্শের কোনও সম্পর্কই থাকে না।

বিভিন্ন রকম প্রয়াস প্রচেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে। সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকে বলেছেন। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গভীরভাবে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লিও তলস্তয়। তলস্তয়বাদ অনুসারে মানুষের সত্যিকার মুক্তি কোনও বাহ্যিক উন্নতি বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মধ্যে নয়, বরং অন্তরের সরলতা ও নৈতিক স্বচ্ছতার মধ্যে নিহিত। তলস্তয় ধীরে ধীরে বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে এক কৃষকের মত জীবনযাপন শুরু করেন — নিজের হাতে জুতা বানাতেন, জমিতে কাজ করতেন, সাধারণ পোশাক পরতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল—

যত কম চাইব, তত বেশি শান্তি পাব।

এই দর্শন গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল মহাত্মা গান্ধী–র ওপর। মহাত্মা গান্ধী "সত্য" ও "অহিংসা"–র মাধ্যমে এক নৈতিক সমাজ গঠনের কথা বলেন। তিনি বলেন সরল এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের অর্থ প্রয়োজন সীমিত রাখা, অহং ত্যাগ করা, এবং নিজের শ্রমের মাধ্যমে বাঁচা। তিনি মনে করতেন, সভ্যতা তখনই সত্যিকার, যখন তা মানুষকে আত্মসংযম শেখায়, ভোগবিলাস নয়।

হেনরি ডেভিড থরো তাঁর "Walden" গ্রন্থে তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে এক নির্লোভ, আত্মনির্ভর জীবনযাপনের কথা বলেছেন। 

আজকের দুনিয়ায়, যেখানে প্রতিটি মানুষ তথ্য, বস্তু, প্রযুক্তি ও চাহিদার স্রোতে নিমজ্জিত, সেখানে এই সরল অনাড়ম্বর জীবন কেবল এক দার্শনিক মত নয়, আবারও এক বার প্রতিরোধের রূপ হয়ে উঠতে পারে।

এইখানে আপনি দুইরকম সমস্যা লক্ষ্য করতে পারেন। 

  1. যদি আপনি স্বল্প সঞ্চয়  এবং সরল জীবন বেছে নেন, অনেক অংশে আপনি সমাজের সাথে তাল মেলাতে পারবেন না। বিলাসিতার কথা বলছি না; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান — এইসকলেরই যা খরচ! আপনি স্বল্প সঞ্চয়ে চালাবেন কী করে?
  2. আপনি যে আপনার প্রিয় পরিচিত দশ বিশ জন মানুষকে সাহায্য করবেন, বা তাঁদের জীবনের বড় বড় খরচের সময় পাশে দাঁড়াবেন, সেইটিও বড় কঠিন হয়ে যাবে। আপনি নিজেরটাই তো সামলাতে পারছেন না বা নিজের জন্য বড় করে কিছু করতে চাইছেন না। আপনি অন্যের জন্য কোনও কিছু কী করে করবেন? 
এর আগেও বেশ কয়েক বার বিভিন্ন রূপে কোনও মহামানব এসে সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাপনের কথা বলেছেন। নিজেদের জীবনযাপনের মাধ্যমে উদাহরণ দিয়েছেন। একটা বড় সময় হয়ে গেল আমরা এইরকম কোনও উদাহরণ দেখছি না। অনেক দিন হয়ে গেল আন্তর্জাতিক স্তরে খুব বড়ো কোনও ব্যক্তি আসেননি যিনি নিজের জীবনদর্শনের মাধ্যমে খুব বড়ো কোনও প্রভাব ফেলেছেন। তবে, এইরকম মানুষ আসবেন। আবার আসবেন — আসাটা খুব প্রয়োজন। ভোগ বিলাসিতার বেলুন ক্রমে ফুলে উঠছে। বুদবুদ ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে উঠছে। আর কত বড় হবে? একদিন না একদিন তো অন্তঃসারশূণ্য বেলুন ফাটবে।


This page was last updated on: 7 October 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.