একটা খামতি লক্ষ্য করি। একটা অভাব। সময়ের অভাব, সহানুভূতির অভাব, মনোযোগের অভাব, ভালোবাসার অভাব।
যেন স্পষ্ট আমরা একে অপরকে বলে দিচ্ছি— "না হে বাপু, কোনও সময় নেই তোমার জন্য। তোমার আর আমার পথ আলাদা। তোমার আর আমার জীবন আলাদা। কোনও জায়গা নেই তোমার জন্য।"
যেন একে অপরের সাথে কথা বলছি শুধু তাঁর কাছ থেকে কতটা কী পাওয়া যায়, কত কিছু সুযোগ–সুবিধা আদায় করা যায়, তার জন্য। নেটওয়ার্কিং করতে হবে যে!
তাই আমরা একে অপরের রূপ–রস–গন্ধ, যোগ্যতা–ক্ষমতা–বুদ্ধিমত্তা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপছি। ওহ, তোমার এত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স! বাপ রে, তোমার এত বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয়! বাহ, তুমি কি সুন্দরী! — ক্রমাগত মেপেই চলেছি।
গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে ছদ্ম মতাদর্শ আর বিশ্বাস। এ মা, তুমি বাঁ হাতি, আমি তো ডান হাতি। তুমি আওয়ামী লীগের সমর্থক, আমি ছাত্র আন্দোলন যে। তুমি সকালে ধোসা খাও, আমি ইডলি। এইরকম খুঁজে খুঁজে এক–আধটা ফারাক পাওয়া গেলেই — সোজা বলে দেওয়া যেতে পারে— "এইবার তুমি ভাগো"।
শুধু এতেই শেষ হলে হতো। যেই একটু ফারাক পাওয়া গেল সমালোচনা–তিরস্কার, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ শুরু। কারণ থাকলে তো বটেই, কারণ না থাকলেও কোনও ছাড় নেই — এবং সেটা চলতেই থাকবে।
মানুষ হিসাবে আমাদের প্রধান কাজ যেন অন্যের ভুল ধরা, অন্যের সমালোচনা করা আর অন্যকে অপমানিত–আহত করা।
সহানুভূতি নেই। ভালোবাসা তো একদমই নেই।
![]() |
আমার মা — বিধান সৌধ, ব্যাঙ্গালোরের সামনে। ১৪ জুলাই ২০২১। |
সময়ের অভাব
সময় নেই। তোমার কথা শোনার সময় নেই। তোমার অনুভূতি বোঝার সময় নেই। তোমার সাথে বা তোমার পাশে থাকার সময় নেই। অথচ পরিস্থিতির কিছু না জেনে, না বুঝে বাজে মন্তব্য করে দেওয়ার যথেষ্ট সময় আছে। এই ধরনের আলপটকা সব মন্তব্যের সারাংশই এক— "আমি জানি, তুমি জানো না। আমি ঠিক, তুমি ভুল।"
সময় নেই। এই এক ঘণ্টা পরে আমার ভিডিও কল আছে। আগামী পরশু কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করতে যেতে হবে যে। উইকএন্ডে পার্টি আছে। ফেসবুক গ্রুপে গিয়ে ডিবেট করতে হবে। ইন্সটাগ্রামে রিল দেখতে হবে — অতএব, তোমার জন্য সময় নেই।
কিছু একটা ত্রুটি–বিচ্যুতি পেলেই, বা না পেলেও, তোমার জন্য আর সময় নেই।
মেসেজ ইগনোর করে দেব। ব্লক করে দেব। কোনও উত্তর বা পাত্তা দেব না। ... যতক্ষণ না আমার নিজের কোনও কিছু দরকার লাগছে।
সহানুভূতির অভাব
মনোযোগের অভাব
মনোযোগ–টনোযোগ দিতে পারবো না বাপু। তোমার কাজে, তোমার ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার — তোমার কথা মন দিয়ে শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনটাই আমার নেই। মনোযোগের আশা একদম করো না।
ভালোবাসার অভাব
ভালোবাসা? সে তো অলীক। তুমি আবার ভালোবাসাও চাও? দাবী তো তোমার কম নয়! তোমার কাছে কুঁড়েঘর নেই, তুমি প্রাসাদে থাকার স্বপ্ন দেখছো! তোমার কাছে শুকনো রুটি নেই, তুমি রুপোর থালায় সোনার চামচ করে শাহী খাবার খেতে চাইছো।
ভালোবাসা ছিল না — নেই — থাকবেও না। ভালোবাসার কথা তুমি তুললেই বা কী মনে করে? এই বিষয়ে আর কথা বাড়াতে চাইছি না। ভালোবাসা নেই।
(হয়তো) আপনার প্রশ্ন
হয়তো আপনি এখন একটা প্রশ্ন করার কথা ভাবছেন—
এই যে তুমি এইটা নেই, সেইটা নেই বলে যাচ্ছ, তুমি নিজে কী করছো? তুমি সারা পৃথিবীকে যেন কাঠগড়ায় তুলে দিচ্ছ। তুমি নিজে কাকে কী দাও বাপু?
আপনার এই প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলাম। এত দেরি করলেন যে এই প্রশ্নটা করতে!
এখন আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করছেন। কী জানেন? আপনি যদি আমাকে এই একই কথাগুলো বলতেন যে সহানুভূতি নেই, ভালোবাসা নেই, ইত্যাদি, আমিও আপনাকে থামানোর জন্য, বোধ করি, একই প্রশ্ন করতাম "আরে মশাই, আপনি নিজে কী করছেন? কাকে কী দিচ্ছেন?" এইটা দারুণ মজার ব্যাপার, তাই না?
আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করুন। এই লেখায় এই অবধি কে কাকে এই আক্ষেপ — এই প্রশ্নগুলো করছে, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করিনি। আমি জানি এই অভাবগুলো কোনো একক ব্যক্তির নয়। আমি জানি আপনিও কখনও কখনও বা হামেশাই এই অভাবগুলো অনুভব করে থাকেন। অতএব, "তুমি নিজে কী করছো?" জাতীয় প্রশ্ন করে দয়া করে আপনি নিজেই নিজের কণ্ঠরোধ করবেন না।
আমার মা — স্বপ্না দত্ত
![]() |
আমার মা ওড়িশা–পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে উদয়পুর সমুদ্রসৈকতে। ৫ নভেম্বর ২০২১। |
একবার ভাবছিলাম ওপরের প্রতিটা অনুচ্ছেদ আরও কিছুটা করে লিখি। উদ্ধৃতি, বিবরণ, উদাহরণ দিয়ে আরও কিছুটা বড় করে লিখি। থাক, দরকার নেই। আমি জানি, আপনি আপনার নিজের মতো করে — নিজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিটা অংশই আরও অনেকটা ভেবে নিতে পারবেন।
এইবার বলি আমার মায়ের কথা। এই যে নানা অভাবের কথা (সময়ের অভাব, সহানুভূতির অভাব, মনোযোগের অভাব, ভালোবাসার অভাব) বললাম আমিও প্রচণ্ড রকম এই সকল অভাব বোধ করি। আগেও খুব অভাব বোধ করতাম। এখন যেন আরও বেশি বেশি অভাব বোধ করছি।
গত ২৭ জুলাই ২০২৫, রবিবার, আমার মা স্বপ্না দত্ত মারা গেছেন। আজকে মায়ের মৃত্যুর পর ২৫ দিন পার হলো। আজকে যখন ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, লক্ষ্য করি — বুঝতে পারি — আমার প্রতি আমার মায়ের ব্যবহারে এই একটা অভাবও ছিল না। না ছিল সময়ের অভাব। না মায়ের ছিল সহানুভূতি বা মনোযোগের অভাব। ভালোবাসার অভাবও ছিল না।
সমস্যা হচ্ছে, আমার মা মারা গেছেন। ফলে, আমার যে একটাই সম্পর্ক ছিল, যাঁর তরফ থেকে আন্তরিকতার অভাব ছিল না — সেইটাও গেছে।
আচ্ছা, অহেতুক নাকে–কান্না কাঁদবো না। কিন্তু, এই পুরো বিষয়টাই আমার মনে হয়তো খুব বেশি চাপ ফেলে চলেছে।
ব্যাস, এই অবধি। পঞ্চম অধ্যায় এইখানেই শেষ করলাম।
এই শব্দটা আজ লিখতে ইচ্ছে করছে না, জোর করেই লিখছি — চরৈবেতি।
স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)
- ● বাংলায় পড়ুন: প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় অধ্যায় (সংযোজন), চতুর্থ অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, তৃতীয় পরিচ্ছেদ), পঞ্চম অধ্যায়
- ● Read in English: First Chapter, Second Chapter, Third Chapter (Addendum), Fourth Chapter (Part I, Part II, Part III), Fifth Chapter
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here
No comments:
Post a Comment
Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.