স্বপ্না দত্ত। আমার মা। আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু লেখা আমার পক্ষে কঠিন এবং আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিতও নই যে আমার লেখা উচিত কিনা। অথবা আমি লিখতে সক্ষম বা উপযুক্ত কি?
আমার মা স্বপ্না দত্ত (জন্ম ২ অক্টোবর ১৯৫৩) গত ২৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে মারা গেছেন। আমি শুনেছি যে বেশ কিছু ধর্মমত, ব্যক্তিমত এবং আচরণপন্থা যেমন সনাতনধর্মের কিছু সম্প্রদায়, ইসলাম ধর্ম ইত্যাদি প্রয়াত ব্যক্তির ছবি বা স্মৃতি রাখতে বারণ করে। এই মতের একটা দৃঢ় কারণ থাকতে পারে যে এই স্মৃতি আমাদের অতীতে আবদ্ধ করে। তাতে ক্ষতি (হয়তো) নেই, কিন্তু সেই অতীতের স্মৃতি অপরিবর্তনীয়। ঠিক, ভুল, ঘটনা, আচরণ সবই অপরিবর্তনীয়। আর মূল কথাটি হলো মানুষটি তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু, অপর দিকে, দেখেছি, আরও কিছু আচরণপন্থায় প্রয়াত ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশ্যে অনেক কিছু লেখা হয়, নির্মিত হয়। আমি সম্প্রতি এক প্রিয় ব্যক্তির সাথে কথা বলেছি, যিনি তাঁর এক কাছের মানুষের (আধ্যাত্মিক গুরুর) মৃত্যুর পর কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন, এবং এই যন্ত্রণাময় সময়ে তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক গুরুকে নিয়ে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। পুস্তিকা লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়েই লেখা শুরু করি।
প্রভেদ
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে লেখা অনেক সময় হয়তো অসুবিধার সৃষ্টি করে। এবং পাঠকেরও হয়তো পড়তে অসুবিধা হয়। সেই লেখায় না থাকে খুব উত্তেজক কোনো কীর্তি, বা প্রচুর বড় কোনও কাজ। উঁচু পাহাড়ে ওঠা নেই, গভীর জঙ্গলে যাওয়া নেই। সম্মানীয় পুরস্কার পাওয়া নেই। কিছু নেই। ফলে লেখার কী আছে? আর কী থাকতে পারে? আছে দুঃখ, আছে বেদনা, তবে সেইসব কেই বা পড়তে বা লিখতে চায়? বিশেষ করে সেই দুঃখ বা বেদনা যদি হয় অতি গড়পড়তা। একের পর এক হারানো, একের পর এক ধাক্কা, অপ্রাপ্তি, অপমান। এইসব নিয়ে কি লেখা যায়?
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুলের) একটি গল্প আছে নাম "প্রভেদ"। গল্পটি কী রকম? ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানের বেশ অনেক বছর পর কোনও এক বছর নানা জায়গার মতো এই বাংলার কোনও এক ছোট অফিসে শহীদ ক্ষুদিরামের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই সভায় অফিসের বিভিন্ন ব্যক্তি ক্ষুদিরামের অবদান সম্পর্কে নানা কথা বলছেন। "ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান।"
যোগেনবাবু, এই অফিসের এক বয়স্ক কর্মচারী একমনে এইসব কথাগুলি শুনছেন। এইসব কথা শুনতে শুনতেই যোগেনবাবুর নিজের সংসারে নানাবিধ সমস্যার কথা মনে পড়তে থাকে। ঘরে আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, চিকিৎসা প্রয়োজন অথচ অবস্থা প্রতিকূল। বাড়িওয়ালার ঘর ভাড়া দেওয়া হয়নি। মুদির দোকানে টাকা দেওয়া হয়নি। যোগেনবাবুর মনে পড়ে।
মঞ্চে তখন সুদক্ষ বক্তারা বলে চলেছেন– "যে বৃটিশের সিংহ-শক্তির ভয়ে সেদিন সমস্ত বিশ্ব কম্পমান ছিল, ভারতবর্ষ থেকে সেই বৃটিশ শক্তির উচ্ছেদ-কল্পে নির্ভয়ে এগিয়ে গেল কে? বাংলা মায়ের দুরন্ত ছেলে কিশোর ক্ষুদিরাম। পরাধীনতার যে কারাগারে সমস্ত ভারত বন্দী ছিল সেদিন সেই কারাগারের পাষাণ প্রাচীরে মাথা কুটে রক্তাক্ত হয়ে মরেছিল কে? আমাদেরই ক্ষুদিরাম। সাম্রাজ্যবাদীর স্পর্ধিত দম্ভের শীর্ষে বজ্র হানতে হবে ঠিক করেছিল সেদিন বাঙালী, সেই বজ্রনির্মাণে প্রথম অস্থিদান করেছে কোন দধীচি? আমাদেরই ক্ষুদিরাম।"
এইসব কথা শুনতে শুনতে বৃদ্ধ যোগেনবাবুর মনে পড়তে থাকে তাঁর নিজের কৈশোর যৌবনের কথা। যোগেনবাবুও একসময়ে অনুশীলন সমিতির সাথে যুক্ত ছিলেন। শহীদ ক্ষুদিরামের আজ স্মরণসভা হচ্ছে, সেই ক্ষুদিরাম যোগেনবাবুর বন্ধু ছিলেন। প্রফুল্ল চাকীর সাথে তাঁর আলাপ ছিল। সেই দুরন্ত সময়ে যখন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী আত্মবলিদানের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন, যোগেনবাবু পারেননি। বাবা মায়ের চোখের জল, তাঁদের অনেক আকুতি মিনতি, সংসারের নানা বাধা ঠেলে যোগেনবাবু ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর পথে পা বাড়াতে পারেননি। এরপর? ধীরে ধীরে বহু বছর কেটে গেছে।
যোগেনবাবুর ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে যে তিনি সারাজীবন কী করলেন? পরিবেশের অভাবে ভাল চাকরিও জোটেনি একটা। সামান্য কেরানীগিরি করতে করতেই জীবনটা কেটে গেল। বাবার অনুরোধে বাবারই এক দরিদ্র বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। বাবা মা মারা গেছেন, শ্বশুরমশাইও মারা গেছেন। তাঁর সমস্ত সংসারটার সম্পূর্ণ দায়ভার তাঁর কাঁধে। ঘরে শত দারিদ্র্য। তাঁর নিজের পাঁচটি মেয়ে হয়েছিল। সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাগুলি প্রায় শেষ, কিছু ঋণও হয়েছে। ছেলে এখনও বড় হয়নি। কিন্তু যোগেনবাবুর জীবন তো শেষ হতে চললো।
বনফুলের লেখা এই গল্পের শেষে বৃদ্ধ যোগেনবাবু যখন স্মরণসভা থেকে বেরিয়ে আসছেন, তাঁর মনের মধ্যে কিছুটা ক্রোধ, কিছুটা আক্রোশ, অনেকটা হতাশা-সহ কিছু কথা ভেসে ওঠে। এই জায়গাটা সরাসরি লেখকের ভাষায় বলি—
যোগেনবাবু, আর ভাবতে পারলেন না । প্রকাণ্ড বোঝা মাথায় নিয়ে জীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন—আর যেন পারছেন না। প্রতিদিন পলে পলে নিজের জীবনীশক্তি ক্ষয় করে তিনি এই যে বিরাট পরিবার পালন করে এসেছেন কী মূল্য আছে এর? এর জন্যে কেউ মনে করে রাখবে না তাঁকে। যুগে যুগে ক্ষুদিরাম, প্রফল্ল চাকীদের নিয়ে সভা হবে, তাঁর কথা মনেও থাকবে না কারও। পরিবার পালন করার জন্য কেউ কাউকে বাহবা দেয় না, তিনিও দেন না। অথচ পরিবার নিয়েই সমাজ, সমাজ নিয়েই দেশ। সৎপথে থেকে সংসারধর্ম পালন করে তিনিও যে প্রকৃতপক্ষে দেশ সেবাই করেছেন, এ কথা কেউ ভাববেও না! ফাঁসির মঞ্চে মরাটাকেই লোকে বেশি বীরত্ব বলে মনে করে, কবিরা তা নিয়ে কবিতা লেখে, তিলে তিলে মরাটা চোখে পড়ে না কারও।
এইটাই প্রভেদ। একজন মানুষ যিনি দাঁতে দাঁত চেপে তিলে তিলে নিজেকে ক্ষইয়ে ফেলছেন, তাঁর কাজ, তাঁর অবদান কে মনে রাখবে? তা নিয়ে না লেখা হবে কবিতা বা গাঁথা, না তা থাকবে স্মৃতিতে জীবিত হয়ে। অথচ এইরকম মানুষ, এইরকম প্রাণ, এইরকম জীবন তো প্রচুর। এইটি তো শুধু আমার মা স্বপ্না দত্তের কথা নয়। আমাদের সবার জীবনই তো এই। বিশ্বজীবন — বিশ্বপ্রাণই তো এই। কান্নার অভিব্যক্তি দিয়ে জীবন শুরু, নিশ্চুপ যন্ত্রণাময় জীবন। তারপর অকস্মাৎ মৃত্যু। আগামী কাল হয়তো ভালো হবে, আগামী কাল হয়তো না বলা কথা, বুকের মাঝে জমিয়ে রাখা ব্যথাগুলো বুঝতে আর তাতে মলম লাগিয়ে দিতে কেউ আসবেন। কে তিনি যিনি আসবেন? জানা নেই, আর আসেনও না। যেহেতু, আর কোনও পথ নেই, কেউ কোথাও নেই, তাই ভগবান, আল্লাহ অথবা মা কালীতেই ভরসা করতে হয়। তবে তাঁরাও তো আসেন না বা কিছু করেন না। এইভাবে দিন যায়, কাল যায়। আর একদিন সব শেষ হয়ে যায়।
আরেকটি জিনিস বলি। এইটি সদ্গুরুর একটা বক্তৃতায় শুনেছিলাম। একটু মনোযোগ দিন। ধরুন একজন মহিলার একজন বা দুইজন সন্তান। সেই ছোট শিশুদের ছোট থেকে বড় করা, চান করানো, খাওয়ানো, পড়াশোনা করানো, তার সাথে সংসারের হাজার কাজ — এইটাই তো একটা বিশাল বড় কাজ। বিশাল বড় প্রোজেক্ট। বিশেষ করে সেই মহিলা যদি দুর্বল বা দুঃস্থ হন, তাহলে তো তাঁর পক্ষে সেই কাজ করাটা এক বড় সংগ্রামের মতো। অথচ আমাদের সমাজে এই লড়াই, এই সংগ্রাম পুরোপুরি অবহেলিত, এবং স্বীকৃতিবিহীন। এইটাই প্রভেদ।
![]() |
স্বপ্না দত্ত, আমার মা, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে মাকে রুবী হাসপাতালে, আর তারপরই আরেকটি রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেইখান থেকে ডিসচার্জের দিন কুড়ি পর। |
চরৈবেতি
যা লিখছি বা যা লিখবো তা আমার মা স্বপ্না দত্তকে নিয়ে অবশ্যই, কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এইটা আমাদের কথা। আমাদের সকলের কথা। দেখুন, বহু মানুষ, বহু প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে, আর এর পরেও হবে।
মহাভারতের বনপর্বে, ধর্ম যিনি যুধিষ্ঠিরের পিতা এবং যক্ষ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তিনি যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন— "এই পৃথিবীর, এই জীবনের সবথেকে আশ্চর্য কী?"
যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন— "প্রতিদিন অগণিত প্রাণী মৃত্যুর গহ্বরে বিলীন হচ্ছে, তবুও যারা বেঁচে আছে, তারা মনে করে যেন মৃত্যুর ছোঁয়া তাদের কখনও স্পর্শ করবে না। এর চেয়ে বড় আশ্চর্য আর কিছুই নেই।"
প্রথম অধ্যায় এইখানেই শেষ করছি। এরপর আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। ঠিক কীভাবে লেখাটা এগিয়ে নিয়ে যাবো, আর কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো, জানি না।
চরৈবেতি।
স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)
- ● বাংলায় পড়ুন: প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় অধ্যায় (সংযোজন), চতুর্থ অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, তৃতীয় পরিচ্ছেদ), পঞ্চম অধ্যায়, ষষ্ঠ অধ্যায়, সপ্তম অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ)
- ● Read in English: First Chapter, Second Chapter, Third Chapter (Addendum), Fourth Chapter (Part I, Part II, Part III), Fifth Chapter, Sixth Chapter, Seventh Chapter (Part I)
This page was last updated on: 2 August 2025
Number of revisions on this page: 5
Internet Archive Backup: See here
No comments:
Post a Comment
Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.