Saturday, September 06, 2025

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মানব বুদ্ধিমত্তা (৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম কয়েক মাস আগে। লেখাগুলো প্রধানত দুটো বিষয়ের ওপর ছিল— ১) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তার বিভিন্ন অগ্রগতি বিষয়ে প্রতিক্রিয়া এবং অভিমত। ২) নির্দিষ্ট সার্ভিস বা প্রোডাক্ট যেমন চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি নিয়ে আলোচনা। গত একমাসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক লেখা হয়নি। আগামী সময়ে নিয়মিত এই বিষয়ে লেখার চেষ্টা করবো, এবং ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই লেখার ইচ্ছা আছে।

প্রচুর চাহিদা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন সব জায়গায়। দিন দিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই প্রযুক্তিতে আর্থিক বিনিয়োগ। আপনি যেই সেক্টর বা সার্ভিসই দেখুন, সেইখানেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যাপারটা মূলত কী? একটা প্রসেসকে বা যন্ত্রকে প্রচুর পরিমাণ ডেটা বা তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। (যদিও ছোট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলের অপেক্ষাকৃত কম ডেটা প্রয়োজন হয়।) এখন, সেই প্রসেস বা যন্ত্রের কাছে প্রচুর তথ্য এলো। এইবার সেই প্রসেস বা যন্ত্রের প্রয়োজন একটা অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেসর (GPU/TPU), যাতে সে এই বিশাল তথ্য বুঝতে বা প্রসেস করতে পারে, বিভিন্ন প্যাটার্ন এবং অ্যালগোরিদম তৈরি করতে পারে, এবং ব্যবহারকারীর নির্দেশ অনুযায়ী সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে পারে। 

এর প্রতিটা স্তরেই রয়েছে প্রচুর চাহিদা। প্রচুর ডেটা বা তথ্য চাই, প্রচুর স্টোরেজ চাই, খুব শক্তিশালী প্রসেসর চাই, আর এইসব কিছু চালাতে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ চাই। প্রশিক্ষণের সময় বিদ্যুতের চাহিদা সবথেকে বেশি।

যদি এমন হতে পারতাম

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল যেমন গুগল জেমিনি, চ্যাটজিপিটি, গুগল এ. আই. স্টুডিও, মেটা এ. আই, 𝕏 গ্রক ইত্যাদি ব্যবহার করতে গিয়ে বহুবার মনে হয় যে যদি আমিও এত দ্রুত এবং সুদক্ষভাবে কথা বলতে পারতাম বা কিছু কাজ করতে পারতাম। ধরুন একটা কয়েক পৃষ্ঠার লেখা, বা কোড আপনি একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলকে দিলেন। যেই দ্রুততার সাথে সে এই তথ্য প্রসেস করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে, সত্যিই দুর্দান্ত। অত্যন্ত দ্রুত গতি ছাড়াও এই সকল মডেলগুলোর কাছে যে বিশাল তথ্যভাণ্ডার রয়েছে, সেইটাও ঈর্ষণীয়। 

একজন মানুষের সাথে কল্পনা করে দেখুন। ধরুন, তাঁর কাছে এত বিশাল তথ্য রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অত্যন্ত দ্রুত পড়তে পারে এবং উত্তর দিতে পারে, তথ্য প্রসেস করতে পারে। এমন হলে, দুর্দান্ত ব্যাপার হতো কিন্তু।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে গিয়ে বারবার উৎফুল্ল হই। তবু, মাঝে মাঝে একটা ঈর্ষা বা দুঃখ মনের মধ্যে জেগে ওঠে— ইশ, যদি আমিও এমন হতে পারতাম। 

ভবিষ্যৎ কী?

আপনার বা আমার কাছে একটা খুব শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান টুল বা গ্যাজেট আছে, সে তো বুঝলাম। কিন্তু, এইখানেই প্রাপ্তির অভীপ্সা শেষ হবে বলে বোধ হয় না। আমার সাধ না মিটিলো। একজন মানুষের নিজের মধ্যেও তো এই ক্ষমতাগুলো চাই। বাহ্যিক টুল হিসাবে নয়, একবারে নিজের অস্তিত্বের অংশ হিসাবে। 

এই বিষয়ে বর্তমানে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি কাজ হবে। বর্তমানে কয়েকটা ক্ষেত্র, যেইখানে এই নিয়ে কাজ হচ্ছে, উদাহরণ দিই। 

এখন যে গবেষণাগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম মস্তিষ্ক–কম্পিউটার ইন্টারফেস বা Brain–Computer Interface (BCI)। এর মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের সিগন্যাল সরাসরি একটি কম্পিউটার বা যন্ত্রে পাঠানো যায়। এর ব্যবহারিক দিকও ইতিমধ্যেই দেখা গেছে—যেমন প্যারালাইসড রোগী শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে কম্পিউটারের কার্সর নাড়তে পারছেন। 

নিউরালিঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে মানবদেহে চিপ ইমপ্ল্যান্ট করে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছে। ২০২৪ সালে প্রথম ব্যক্তি চিন্তা দিয়ে কনসোল বা কার্সর নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন Synchron, Paradromics, BrainGate-ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে।

চীন একটি জাতীয় কৌশল ঘোষণা করেছে যা ২০২৭ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে BCI-তে বড় এবং উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করার চেষ্টা করছে।

যদি এই প্রযুক্তি বড় পরিসরে সফল হয়, তাহলে আমরা সরাসরি তথ্য 'ডাউনলোড' করতে বা মস্তিষ্ক থেকে মেশিনে নির্দেশ পাঠাতে সক্ষম হব। শেখার গতি, স্মৃতি বা কাজের দক্ষতা হয়তো বা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। যদিও, এই প্রযুক্তি এখনো পরীক্ষামূলক স্তরে আছে, এবং নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, আর নৈতিক দিক নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।

একটি বনভূমিতে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক মেয়ে, পাশে একটি বড় যন্ত্র যার সামনে ঝকঝকে মস্তিষ্কের চিহ্ন ও সার্কিটের নকশা; উপরে একটি পায়রা বসে আছে।

সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হাসপাতাল

যেইখানে আমরা কাজ করতে একেবারেই অক্ষম, যেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের সচল করা বা দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ হিসাবে আমি অত্যন্ত বেশি এবং সর্বাধিক উৎসাহী। 

সম্প্রতি একটা খবর পেলাম যে চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় (Tsinghua University, 清华大学) বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। এই হাসপাতালের যাঁরা ডাক্তার তাঁরা মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত যন্ত্র বা আর্টিফিশিয়াল এজেন্টস। এদের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এই হাসপাতালে ৪২ জন এ. আই. ডাক্তার বিভিন্ন বিভাগে, যেমন কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, নিযুক্ত। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ডাক্তারি প্রসেস এর মধ্যে ১০,০০০+ রোগী দেখে ফেলেছে। পরামর্শ এবং রোগনির্ণয়ের অ্যাকুরেসি ৯৩%। 

৯৩% অ্যাকুরেসি খুব ভালো সাফল্য নয়। ১০০–টার মধ্যে ৭–টায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনও ঠিকমতো রোগনির্ণয় ও পরামর্শ দিতে পারছে না। যেহেতু, বিষয়টা মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত, এই অ্যাকুরেসি আরও ভালো হওয়া উচিত। সে যাই হোক, এইটা একটা দুর্দান্ত ব্যাপার হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই পদ্ধতি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর, এতে যে কত মানুষের কত সুবিধা হবে, তা যতটা ভাবতে পারছি, তাতেই খুব আনন্দিত হয়ে পড়ছি।

বায়োসাইবারনেটিক্স এবং বায়োমিমিক্রি

আমি বিভিন্ন রকম বায়োসাইবারনেটিক্স প্রযুক্তি বা অগমেন্টেড হিউম্যান প্রযুক্তি নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী। বায়োনিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বায়োনিক ইমপ্ল্যান্ট, মস্তিষ্ক–কম্পিউটার ইন্টারফেস নিশ্চিতভাবে আমাদের জীবনে প্রচুর প্রভাব ফেলবে। অনেক কিছু হয়তো অনেক সহজ, সুলভ এবং শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

আমি নিউরালিংক কোম্পানির কাজের বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। যেই কথাগুলো বলছিলাম যে আমরাও যদি এ. আই. মডেলগুলোর মতো অত বিশাল তথ্যের অধিকারী হতে পারতাম বা অত দ্রুত কাজ করতে পারতাম, বোধ করি নিউরালিংক এবং এই জাতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে সেইটাও অনেকটা করা সম্ভব হবে।

তারই সাথে একটা চিন্তাও রয়ে যাচ্ছে। দেখুন, ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন বায়োমিমেটিক্স অনুসরণকারী। বায়োমিমেটিক্স বা বায়োমিমিক্রি হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন একটি দর্শন, যেখানে মানুষ প্রকৃতির কৌশল, নকশা, বা সমাধান অনুকরণ করে নতুন প্রযুক্তি, স্থাপত্য, বা যন্ত্র তৈরি করে। আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায় অসংখ্য বৃহৎ, জটিল এবং সুদক্ষ কাজ ও গঠনের নমুনা। কোনো সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বা নতুন চিন্তার প্রয়োগে আমি প্রথমেই দেখি প্রকৃতিতে সেই জিনিসটি কীভাবে তৈরি হয়েছে।

ধরুন, কম্পিউটার বা মোবাইলের হার্ড ডিস্ক — অ্যালুমিনিয়াম, তামা, কোবাল্ট, নিকেল ইত্যাদি ধাতু এবং সিলিকন, প্লাস্টিক ইত্যাদি অধাতু পদার্থ দিয়ে নির্মিত। অথচ মানব মস্তিষ্কের গঠন একেবারেই ভিন্ন। আয়তনে মানব বা প্রাণীর মস্তিষ্ক অনেক ছোট, তবু তার সংগ্রহণ ক্ষমতা ও প্রসেসিং ক্ষমতা আশ্চর্যজনকভাবে বিশাল। যদি মানব মস্তিষ্ককে একটি যন্ত্র বা ডিভাইস হিসেবে ভাবা যায়, তবে তা যেকোনও হার্ড ডিস্ক বা প্রসেসরের থেকে বহু গুণ উন্নত এবং শক্তিশালী। অথচ এটি ধাতব কাঠামোর মতো গঠিত নয়। বোধ করি, এখানে আমাদের আরও কাজ বাকি। হয়তো ভবিষ্যতে স্টোরেজ প্রযুক্তি ও প্রসেসর নকশা মানব মস্তিষ্কের গঠন থেকে আরও গভীরভাবে অনুপ্রেরণা নেবে।

আমি নিউরালিংক এবং মস্তিষ্ক–কম্পিউটার ইন্টারফেসের কাজ এবং অগ্রগতি অনুসরণ করছি। তার সাথে সাথে এইটাও মনে হচ্ছে এই যে মস্তিষ্কে বা শরীরে ইমপ্ল্যান্ট করা — বায়োমিমিক বা প্রকৃতির নিপুণতা অনুসরণ করে হবে তো? হলে কীভাবে হবে বা অন্য কোনোভাবে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমাধান কী সম্ভব? এই একটা বিষয়ে খটকা রয়ে গেছে। দেখা যাক, কীভাবে ভবিষ্যতে এই সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে যায়।


This page was last updated on: 6 September 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.