Thursday, August 07, 2025

স্বপ্না দত্ত, আমার মা: তৃতীয় অধ্যায় (সংযোজন)

আগামীকাল, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫ (২২ শ্রাবণ ১৪৩২) আমার মায়ের শ্রাদ্ধকার্য অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল তৃতীয় অধ্যায় — "প্রাক–শ্রাদ্ধ অধ্যায়" প্রকাশ করেছিলাম। আজ, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের আগের দিনে, এই অংশটি তৃতীয় অধ্যায়ের "সংযোজন" রূপে প্রকাশ করছি। এইটা হয়তো আগের অধ্যায় সম্পাদনা করে লেখার নীচেই যুক্ত করা যেত। সেইটা করছি না দুইটি কারণে— ১) প্রবন্ধটি প্রকাশের পর ত্রিশ ঘণ্টার বেশি সময় কেটে গেছে, ২) এই "সংযোজন"-এর একটা বড় কারণ হলো তৃতীয় অধ্যায় প্রকাশের পর প্রাপ্ত কিছু প্রতিক্রিয়া। তাই, এই লেখাটি স্বতন্ত্র ভাবে প্রকাশ করছি।

একজন মহিলা কমলা শাড়ি পরে সোনালী বুদ্ধ মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। মূর্তিটি একটি সাদা-ধূসর মার্বেল দেয়ালের সামনে স্থাপিত। মহিলার গায়ে কালো চাদর রয়েছে এবং তিনি চশমা পরেছেন। মূর্তির পাদদেশে ফুলের থালা ও পূজার সামগ্রী রাখা আছে। বাঁদিকে একটি লাল রঙের দানবাক্স রয়েছে।
আমার মা। বারাণসী শহরের এক মন্দিরে।
"বুদ্ধং শরণম্‌ গচ্ছামি"।
১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে তোলা ছবি।

প্রশ্নাবলী

গতকাল তৃতীয় অধ্যায় প্রকাশের পর যেই কয়টি প্রশ্ন এবং মন্তব্য পেয়েছি তার কয়েকটি এইখানে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। আশা রাখি এই সংযোজনটি এর আগের অধ্যায়টিকে অধিক শক্তিশালী করবে এবং তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করবে। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্নকর্তার বা মন্তব্যকারীর নাম উল্লেখ করছি না, শুধুমাত্র বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।


প্রশ্ন: তুমি তৃতীয় অধ্যায়ে নিজের অবিশ্বাস এবং সংশয় সম্পর্কে লিখেছো। তুমি শ্রাদ্ধের কাজগুলো ঠিকমতো শ্রদ্ধা সহকারে করছো তো?
উত্তর: হ্যাঁ। মায়ের মৃত্যুর পর আজ দ্বাদশ দিন চলছে। এই অবধি করা সব কাজ বৈদিক নিয়ম মেনে ঠিকমতো করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি মননশীল হবার এবং বুঝে, অনুভব করে কাজ করার। 

প্রশ্ন: তুমি একদিকে বলছো যে তুমি বিশ্বাস করো না। আবার অপরদিকে তুমি অশৌচ, পিণ্ডদান ইত্যাদি করছো। আমি এইটা বুঝতে পারছি না।
উত্তর: ধর্মানুষ্ঠান, প্রথা, রীতির সমালোচনা করার উদ্দেশ্য আমার ছিল না, নেইও। তবে না জেনে বুঝে, না অনুভব করে কিছু বিশ্বাস করা বা বিশ্বাস করার অনুকরণ করা, বা, যেইটা সবথেকে খারাপ অন্যের ওপর এই অন্তঃসারশূণ্য বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া — এর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করি। এই বিষয়ে উৎসাহী নই।

প্রশ্ন: তোমার বর্তমান আর্থিক অবস্থা তো ভালো নয়। তা সত্ত্বেও, তুমি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে প্রায় ৭০ জনকে নিমন্ত্রণ করে এলাহি আয়োজন করছো কেন?
উত্তর: আমার বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক। আত্মীয়–বন্ধু–প্রতিবেশী মিলিয়ে আনুমানিক ৭০ জন ব্যক্তি এই অনুষ্ঠানে আসবেন বলে আশা করছি। কালকে খুব বৃষ্টি হলে বা অন্য কারণে সমাগত ব্যক্তির সংখ্যা কিছু কম হতে পারে।

শ্রাদ্ধকার্য একটি দেবালয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নিরামিষ খাদ্য পরিবেশিত হবে। মা আর আমার বিশেষ পরিচিত নিকট ব্যক্তিদেরই আপ্যায়ণ করেছি। হয়তো বা এমন হয়েছে যে মায়ের সঙ্গে খুব ভালো পরিচিত এক প্রতিবেশী মহিলাকে নিমন্ত্রণ করছি, আর ঠিক তার পাশের ঘরের আরেক মহিলা রয়েছেন যার সঙ্গে মায়ের একই রকম সুসম্পর্ক ছিল এবং আমার সাথেও পরিচয় আছে, তাঁকে না বললে সেইটা খারাপ দেখায় এবং সেটা ঠিকও হবে না। এইরকম কিছু কারণে আপ্যায়ণের সংখ্যা সামান্য একটু বেড়েছে। 

গত ১২ দিনে প্রতিটি পদক্ষেপে আমি আমার বর্তমান সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করেছি। 

যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব...

"বিশ্বাস" প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি আমার মনোভাব এবং অবস্থানকে ঠিক অবিশ্বাস বলে চিহ্নিত করতে চাইবো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা "প্রার্থনাতীত দান" কবিতার শেষ অংশটি এইরকম—
নবাব কহিল, "মহাবীর তুমি,
          তোমারে না করি ক্রোধ—
বেণীটি কাটিয়া দিয়ে যাও মোরে
          এই শুধু অনুরোধ।"
তরুসিং কহে, "করুণা তোমার
          হৃদয়ে রহিল গাঁথা—
যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব,
          বেণীর সঙ্গে মাথা।"

আমি আমার "বিশ্বাস" উপহার দিতেই পারি। হয়তো বা অনুভূতিহীন ভাবে এবং না মেনে–জেনে। কিন্তু আমার কাছে, বোধ করি, দেওয়ার জন্য তার থেকে ভালো উপহার আছে — উৎসাহ — অনুসন্ধিৎসা । জীবন ও জীবনচর্যা নিয়ে আমি অপরিসীম উৎসাহী। ফলে, আমিও "যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দিব" — বিশ্বাসের সঙ্গে উৎসাহ, অনুসন্ধিৎসা।

নিয়মের থেকে কারণ ভালো

গত বারো দিনে নানা বিষয়ে নানা নিয়ম শুনেছি এবং পালন করার চেষ্টা করেছি। একটা কথা খুব মনে হচ্ছে যে নিয়মের থেকে কারণ ভালো। অথবা, নিয়মের সাথে কারণ অথবা যুক্ত হলে খুব ভালো হয়।

একটা উদাহরণ দিই। অশৌচের দিনগুলিতে হবিষ্যান্ন (নিয়ম মেনে দুপুরের স্বল্প খাবার, মূলতঃ আতপ চালের সিদ্ধ ভাত) খাবার আগে কাককে সেই খাবারের কিছু অংশ দিতে হয়। তারপর নিজে খেতে হয়। এখন শ্রাদ্ধ হয়ে যাবার পর কাককে আর খাবার দিতে হয় না। আবার, খাবার দেবার শাস্ত্রসম্মত বিধিনিষেধ আছে বলেও শুনিনি। কিছু দিন ধরে দেখেছি যে শেষ কয়েকদিন আমি দুপুরবেলা খাবার দেবার জায়গায় গেলেই কয়েকটা কাক দ্রুত উড়ে আসছে — যেন অপেক্ষায় ছিল। আমার কাছে কারণ আছে এই কাককে খাবার দেবার রেওয়াজ চালু রাখার। 

নিয়ম হয়তো শুধু বলে দেয় কী করতে হবে। তার সাথে কারণ বুঝতে পারলে হয়তো বা সেই নিয়ম আরও স্বতঃস্ফূর্ত এবং আন্তরিকভাবে পালন করা যায়।

একটি সাদা ছাদের উপর কলাপাতায় ভাত রাখা আছে, পাশে একটি কাগজের কাপ। পেছনে ঘন সবুজ গাছপালা ও কলাগাছ দেখা যাচ্ছে। দূরে টিনের ছাউনি দেওয়া কিছু ঘর দেখা যাচ্ছে।
দুপুরে হবিষ্যির আগে কাকের জন্য খাবার দেওয়া হয়েছে।
অশৌচের নবম দিন, ৪ অগাস্ট ২০২৫ তারিখে তোলা ছবি।

তৃতীয় অধ্যায়ের সংযোজন অংশ এইখানে শেষ করছি। আজকে ৭ অগাস্ট ২০২৫ (২১ শ্রাবণ ১৪৩২) সকালে ঘাটকাজ করেছি। আগামীকাল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। এর পরের অধ্যায়ে এই দুইদিনের কাজ কেমন হলো, সেই বিষয়ে লেখার ইচ্ছে আছে।

চরৈবেতি।

স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)


This page was last updated on: 7 August 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.