আমার মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ গত বৃহস্পতিবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫ (২২ শ্রাবণ ১৪৩২) তারিখে সম্পন্ন হয়েছে। চান্দ্রমাস অনুযায়ী, এইদিন দুপুর ১:২৮ অবধি শুক্ল চতুর্দশী তিথি ছিল, এবং ১:২৯ থেকে পূর্ণিমা শুরু হয়। সেই হিসাবে আমার মায়ের শ্রাদ্ধের প্রথম অংশ শুক্ল চতুর্দশী তিথিতে এবং অন্য অংশ পূর্ণিমা তিথিতে হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে যথাক্রমে "শ্রাদ্ধ ও শ্রদ্ধা" এবং "ঘাটকাজ" বিষয়ে লিখেছিলাম। এই অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে শ্রাদ্ধদিবস বিষয়ে লিখছি।
বিবেকনগর কালীমন্দির
বিবেকনগর কালীমন্দিরে মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ সংগঠিত হয়। যাদবপুর অঞ্চলে এইটি একটি বিখ্যাত মন্দির। মূলতঃ এইটি একটি কালীমন্দির ছিল। সেইজন্য এই মন্দিরটি বিবেকনগর কালীমন্দির বা কালীবাড়ী নামে পরিচিত। যদিও বর্তমানে এই মন্দির অভ্যন্তরে অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিমাও রয়েছে। তাই মন্দিরটিকে "বিবেকনগর দেবালয়"–ও বলা হয়, এবং এই নামটিই মন্দিরের আনুষ্ঠানিক নাম। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫০ সালে (১৩৫৭ বঙ্গাব্দে)। সোসাইটি হিসাবে রেজিস্ট্রেশন নম্বর: S/9228।
![]() |
বিবেকনগর কালীমন্দির বা বিবেকনগর দেবালয়। |
![]() |
মন্দিরে কালীপ্রতিমা |
![]() |
রাধাকৃষ্ণ প্রতিমা |
![]() |
মন্দিরের অভ্যন্তরে দেওয়ালে ও মেঝেতে অনেক স্মৃতিফলক রয়েছে। বহু মানুষের — বহু জীবনের স্মৃতি বহন করছে এই ফলকগুলি। |
শ্রাদ্ধের স্থান
শ্রাদ্ধের জন্য আমরা কালীমন্দিরের দোতলা সেইদিন ভাড়া নিয়েছিলাম। দুইখানা মাঝারি আকারের ঘর, সংযোগকারী বারান্দা, একটা ঘর কিচেন হিসাবে ব্যবহারের জন্য, এবং টয়লেট। আমার মামা শ্রী শুভব্রত ভট্টাচার্য্য শ্রাদ্ধের দুই দিন আগে এই স্থানের একটা ভিডিও তুলেছিলেন। সেইটি নীচে দিচ্ছি, ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাংলায় ওনার কণ্ঠস্বর।
|
বিবেকনগর মন্দিরের দোতলা। এইখানে মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ করা হয়েছে। |
শ্রদ্ধা নিবেদন
সকাল ১০:৪০ নাগাদ পুরোহিত শ্রী পাপন চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে শ্রাদ্ধের কাজ শুরু হয়। অনুষ্ঠানের শুরুর সময় আমার মামা শুভব্রত ভট্টাচার্য্য এবং আমি ছিলাম। পুরোহিতের নির্দেশে আমি শাস্ত্রানুসারে শ্রদ্ধানিবেদন, মন্ত্রোচ্চারণ, এবং প্রার্থনা শুরু করি।
প্রণাম
শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে শ্রীবিষ্ণুকে পুনঃপুনঃ প্রণাম জানানো হয়। প্রধান মন্ত্র হলো—
বাংলা: ॐ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়।
বিষ্ণুকে প্রণাম জানানোর পর সকল দেবদেবীকে প্রণাম জানানো হয়। শিবপ্রণাম, গঙ্গা–যমুনা–সরস্বতী নদীকে প্রণাম, যমকে প্রণাম ইত্যাদি। এই ছাড়াও এই প্রণাম অংশে পিতৃপুরুষাভ্য (পূর্বপুরুষদের), আর সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের প্রতি প্রণাম জানানো হয়। এই প্রণাম অংশটি বেশ বিস্তৃত।
প্রায়শ্চিত্ত
প্রায়শ্চিত্ত শ্রাদ্ধ কাজের একটি প্রাথমিক অংশ। প্রায়শ্চিত্তে মন্ত্রোচ্চারণ এবং সংকল্পের মাধ্যমে অশৌচকালে হয়ে থাকা ভুল–ত্রুটি, মনোযোগহীনতা, শাস্ত্রবিধি পরিপন্থী কাজ যদি কিছু হয়ে থাকে, সেই সকলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও অনুশোচনা করা হয়।
ষোড়শ দান
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় বড় পর্যায় হলো দান। যদি ষোড়শ দান করা হয় তাহলে যেই ষোলোটি জিনিস উৎসর্গ করা হয়, সেইগুলি হলো—
- অন্ন (চাল বা প্রধান খাদ্যসামগ্রী, সাথে পাঁচরকম মিষ্টি),
- উত্তরীয় যেমন শাল,
- কলস বা জলসহ জলাধার,
- বস্ত্র (শাড়ি বা ধুতি),
- প্রদীপ,
- শাকসবজি ও রন্ধন উপকরণ — বিভিন্ন মশলা, নুন, সর্ষের তেল,
- স্বর্ণ (প্রতীকী হিসাবে টাকা দেওয়া হতে পারে),
- রৌপ্য (প্রতীকী হিসাবে টাকা দেওয়া হতে পারে),
- ভূমি (প্রতীকী হিসাবে টাকা দেওয়া হতে পারে),
- জুতো বা চটি,
- তাম্বুল,
- ছত্র বা ছাতা,
- সুগন্ধী (চন্দনকাঠ ইত্যাদি)
- মালা বা পুষ্পস্তবক (সাদা ফুল যেমন রজনীগন্ধা)
- ফল (বিভিন্ন রকম ফল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলা হয় প্রয়াত ব্যক্তির প্রিয় পাঁচরকম ফল একটি করে),
- শয্যা বা বিছানা।
ষোড়শদানের সামগ্রী বিভিন্ন সম্প্রদায়, মতবাদ, এবং অনুষ্ঠানপদ্ধতিতে সামান্য ভিন্ন হতে পারে। ষোড়শদান শুধুমাত্র ষোলোটি বস্তু বা সামগ্রীর দান নয়, বরং এই দানগুলির সবকটিই দৈনন্দিন জীবনে আবশ্যক এবং একই সঙ্গে প্রতীকী। এই দান প্রয়াত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, যাতে তাঁর পারলৌকিক জীবন বা যাত্রাপথে কোনও অভাব না থাকে। একটু অন্যভাবে দেখলে মা অথবা বাবা একটা সময়ে তাঁর সন্তানের জন্য অন্ন, বস্ত্র ইত্যাদি জোগাড় করেছিলেন। এখন তাঁর মৃত্যুর পর সন্তান চেষ্টা করছে যাতে মায়ের অথবা বাবার পারলৌকিক জীবনে অভাব না হয়।
এই সকল জিনিসের ব্যবহারিক গুরুত্ব — যাঁর উদ্দেশ্যে এইসকল সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে তিনি কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা আমার জানা নেই। তবে আত্মিক বা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এই প্রয়াস খুব অর্থপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী বোধ করি।
![]() |
আমার মায়ের জন্য ষোড়শ দান। |
সকল শ্রাদ্ধে যে ষোড়শদানই করতে হবে এমন নয়। অন্যান্য প্রকারের দানও রয়েছে। যেমন—
- ত্রিদান (অন্ন, বস্ত্র, জল),
- চতুর্দান (অন্ন, বস্ত্র, জল, ফল),
- রাজকীয় দান বা রাজদান (গরু, সোনা, রূপো, ভূখণ্ড ইত্যাদি, সাথে ষোড়শদানের সামগ্রী),
আমার মায়ের শ্রাদ্ধে আমি ষোড়শদান করেছি।
পিণ্ডদান
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের তৃতীয় অংশ হলো পিণ্ডদান। আতপ চাল, তিল, কলা, এবং মিষ্টি (সন্দেশ) দিয়ে গোলাকার পিণ্ড প্রস্তুত করা হয়। পিণ্ডগুলি মৃত ব্যক্তির আত্মার আহার্যের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় যাতে সেইগুলি তাঁর পারলৌকিক যাত্রায় তাঁকে শক্তিপ্রদান করতে পারে। পিণ্ডদান মূলতঃ তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে করা হয়— প্রয়াত ব্যক্তি, তাঁর মাতা/পিতা এবং পিতামহী/পিতামহ। এইছাড়া, পিণ্ডদানের শুরুতে যদি বংশের কারও অপঘাতে (যেমন অগ্নিদগ্ধ বা আগুণে পুড়ে) মৃত্যু হয়ে থাকে বা পূর্বপুরুষদের মধ্যে কারও শ্রাদ্ধ কোনও কারণে না হয়ে থাকে, তাঁদের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করা হয়।
পিণ্ডদানের সময় বিভিন্ন মন্ত্র পাঠ করা হয়, যা পূর্বপুরুষের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন এবং তাঁদের আত্মার শান্তি কামনার সঙ্গে সংযুক্ত। পিণ্ডদান বংশের ধারাবাহিকতা এবং প্রজন্মের বন্ধনকে নির্দেশ করে।
|
পিণ্ডদান পর্বে পিণ্ডনির্মাণের কাজ করছি। |
গীতাপাঠ
আমার মায়ের শ্রাদ্ধের দিন মূল শ্রদ্ধানিবেদনের পাশাপাশি গীতাপাঠের আয়োজন করেছিলাম। বিবেকনগর কালীমন্দিরের পুরোহিত শ্রী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় শ্রাদ্ধ চলাকালীন সমান্তরালভাবে শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা পাঠ করছিলেন।
শ্রী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় গীতাপাঠ করছেন। |
আত্মীয় পরিজনের শ্রদ্ধানিবেদন
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান চলাকালীন আত্মীয় পরিজন এবং পরিচিত ব্যক্তিরা মায়ের ছবিতে মাল্যদান করে মাকে স্মরণ করেন ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন।
![]() |
মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধানিবেদন। |
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ইমন ভট্টাচার্য্য, আমার মামাতো বোন, যিনি মূল শ্রাদ্ধপর্বে অংশ নিয়ে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন ও তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করেন।
ইমন ভট্টাচার্য্য আমার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন। সমান্তরালভাবে গীতাপাঠ চলছে। |
শ্রাদ্ধের মূল কাজ এবং মন্ত্র পাঠের পর উপস্থিত আত্মীয়–পরিজন এবং শুভানুধ্যায়ীদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা হয়। মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে পুরোহিত এবং ক্যাটারিং–এর কর্মীগণ বাদে মোট ৭২ জন উপস্থিত ছিলেন। এই কঠিন সময়ে তাঁদের উপস্থিতি আমাদের জন্য এক মানসিক সহায় ছিল। একত্রিত হয়ে মায়ের আত্মার শান্তি কামনার মধ্য দিয়ে শ্রাদ্ধের সম্পূর্ণতা লাভ করে।
![]() |
শ্রাদ্ধের শেষে শুভানুধ্যায়ীদের দুপুরের আহার। |
![]() |
ছবির ডানদিক থেকে বামদিকে রয়েছেন— শ্রী বাপি দাস, শ্রী নীলম পণ্ডা, শ্রী অর্ক মালিক, এবং আমি। |
উপসংহার
বুকের মধ্যে এক অবসন্নতা বোধ করছি ... একটা ভোঁতা অনুভূতি।
চতুর্থ অধ্যায়, তৃতীয় পরিচ্ছেদ — শ্রাদ্ধদিবস — এইখানেই শেষ করলাম।
চরৈবেতি।
স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)
- ● বাংলায় পড়ুন: প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় অধ্যায় (সংযোজন), চতুর্থ অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, তৃতীয় পরিচ্ছেদ), পঞ্চম অধ্যায়, ষষ্ঠ অধ্যায়, সপ্তম অধ্যায় (প্রথম পরিচ্ছেদ)
- ● Read in English: First Chapter, Second Chapter, Third Chapter (Addendum), Fourth Chapter (Part I, Part II, Part III), Fifth Chapter, Sixth Chapter, Seventh Chapter (Part I)
This page was last updated on: 20 August 2025
Number of revisions on this page: 2
Internet Archive Backup: See here
No comments:
Post a Comment
Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.