Friday, August 29, 2025

স্বপ্না দত্ত, আমার মা: ষষ্ঠ অধ্যায়

২৭ অগাস্ট ২০২৫ — আমার মায়ের মৃত্যুর পর একমাস কেটে গেছে। এই সিরিজের লেখাগুলোতে আমার মায়ের সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করছি। তারই সাথে খুব চেষ্টা করছি যেন লেখাগুলো শুধুমাত্র কোনও বিশেষ ব্যক্তির রোজনামচা না হয়ে, বৃহত্তর জীবনকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। তাই, পূর্ব প্রকাশিত অধ্যায়গুলোতে হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে অনেকটা অংশ জুড়ে মায়ের সম্পর্কে স্মৃতি ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে। এইদিন মা এই করেছিলেন, সেইদিন সেইটা হয়েছিল, আরেকদিন ওইখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম — এইরকম একটা ক্রমধারায় জীবনী (chronological biography) লিখতে চাইছি না। এক ব্যক্তির আত্মিক, বৌদ্ধিক এবং মানসিক প্রতিমা, বৃহত্তর মানবজীবন এবং আবেগ–অনুভূতির কথা মাথায় রেখে, শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

একটি সাধারণ ঘরের ভেতরে একটি বিছানায় মা তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন। পেছনে জংধরা দেওয়াল আর জানালায় গ্রিল, পাশে কাঠের টেবিলে একটি ছোট সাদাকালো টেলিভিশন রাখা আছে।
আমার মা। মায়ের কোলে মাঝখানে আমি।
আমার বাঁ ও ডান পাশে রুপেন আর টুপাই। প্রতিবেশী বন্ধু। 
আনুমানিক ১৯৯০ সালের ছবি। আমার বয়স তখন ~৩ বছর।

কথায় বলে বেঁচে থাকা — শরীর ধারণ করাই — এক বিড়ম্বনা। এই আক্ষেপ অতি প্রাচীন, তবে, বর্তমান সময়েও এই উপলব্ধি একই রকম বা আগের থেকে অধিকভাবে প্রযোজ্য।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, প্রেম — এইসব পণ্যে পরিণত হয়েছিল অনেক আগে। এখন দিন দিন এই জিনিসগুলো ক্রমে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শৌখিন জিনিসের কথা আপাতত বলছিই না। বেঁচে থাকার একেবারে মৌলিক জিনিসগুলোও যেন দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ। 

সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের মতো দেশে আপনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা জাতীয় পরিষেবা পান না, আপনাকে টাকার জোরে কিনতে হয়। You don't avail of health and education facilities, you purchase them. 

জীবন যেন এক বোঝা — liability — পিঠের ওপর চেপে বসে আছে। আর এর ভার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় জিনিসগুলোর নিরন্তর এবং মাত্রাতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ, স্বাভাবিকভাবে, একটা সমাজে দুশ্চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই দুশ্চিন্তার স্তর অনেককাল আগেই পেরিয়ে গেছে। 

এর সঙ্গে রয়েছে এক মারাত্মক সহানুভূতির অভাব। দ্বিতীয়, তৃতীয়পঞ্চম অধ্যায়ে অনুভূতির অভাব সম্পর্কে কিছু কথা লিখেছিলাম। সার্বিকভাবে একটা অত্যন্ত বড়ো অসামঞ্জস্য আছে — একটা ভয়াবহ ঘৃণা এবং অবহেলার পরিবেশ। 

হিংসা, ঘৃণা, দুর্নীতি, জালিয়াতি, অহংপ্রদর্শনের লড়াই, একে অন্যের প্রতি অবজ্ঞা আর যা যা সমস্যা চোখে পড়ে, এইটা খুবই সম্ভব যে সেইগুলো আমাদের মনের মধ্যে থাকা সুপ্ত চেতনার এবং অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। এইটা সম্ভব যে আসলে সকল আচরণ মানসিক স্তরে বা গভীরতর স্তরে রয়েছে। যেটা চোখে পড়ছে, এবং আমরা যাকে সমস্যা বলে চিহ্নিত করছি, সেইটা সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মূল সমস্যা অনেক গভীরে নিহিত। আর যদি এইটা সত্যি হয়ে থাকে, সমস্যাটা অনেক বেশি জটিল হয়ে যায়।

সাহির লুধিয়ানবী (১৯২১–১৯৮০) "তাজমহল" নামক একটি গজল রচনা করেছিলেন। এই গানটি ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত "গজল" চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়। গানটি প্রেমের প্রতীক তাজমহলের উদ্দেশ্যে রচিত। 

হিন্দি: इक शहंशाह ने दौलत का सहारा ले कर
हम ग़रीबों की मोहब्बत का उड़ाया है मज़ाक़।
বাংলা লিপি: ইক শহনশাহ নে দৌলত কা সহারা লে কর
হম গরীবো কি মোহব্বত কা উড়ায়া থা মজাক।
বাংলা অনুবাদ: এক সম্রাট তাঁর ধনসম্পত্তির দম্ভে 
আমাদের মতো গরীবদের ভালোবাসার পরিহাস করেছিলেন।

গানটিতে এক বিরহ, এক যন্ত্রণা বারবার ফিরে আসে। আর সঙ্গে সঙ্গে গানের মধ্যে বারবার এক আকুতি ফুটে ওঠে— 

হিন্দি: मेरी महबूब कहीं और मिला कर मुझ से।
বাংলা লিপি: মেরি মহবুব কঁহি অউর মিলাকর মুঝসে।
অনুবাদ: আমার প্রিয়তম, তোমার সাথে অন্য কোথাও দেখা হবে।

আমার মা গত ২৭ অগাস্ট মারা গেছেন। আমার মনের মাঝে এক মারাত্মক অবসন্নতা অনুভব করছি। দুঃখ রয়েছে। তারই সঙ্গে এক অস্বস্তিও রয়েছে। আমার মা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলেই বা আজ এমন কী বিশাল ফারাক হতো? সেই তো একই ডাক্তার–ওষুধ–হাসপাতালের চড়া বিল, সেই তো একই চারিদিকে অনীহা–অবজ্ঞা। এমন তো নয়, মা বেঁচে থাকলেই আজ সবকিছু স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠতো। ভিতরে ভিতরে তো আরও বেশি ক্ষয়ে যেতেন। 

একজন হাসিখুশি মহিলা শাড়ি পরে ঘরের ভেতরে কোলে একটি ছোট শিশুকে ধরে আছেন। শিশুটি লাল পোশাক পরা এবং অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, মা স্নেহভরে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
মায়ের কোলে আমি। 
১৯৮৮–এর শেষের দিকের ছবি। 
আমার বয়স তখন ১ বছর।

মনের মধ্যে একটা খুব অস্বস্তি–অনিশ্চয়তা অনুভব করছি। 

মা, তুমি নেই, আমি খুবই দুঃখিত। তোমাকে আমাকে ভালোবাসি। তবে, তোমার সাথে এইখানে নয় — এইখানে আর নয় — অন্য কোথাও দেখা হবে। 

মেরি মহবুব কঁহি অউর মিলাকর মুঝসে।

স্বপ্না দত্ত, আমার মা (Swapna Dutta, my Mother)


This page was last updated on: 29 August 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.