জপ সিরিজের তৃতীয় অধ্যায় লেখা শুরু করছি। যে কোনও কাজ করার ক্ষেত্রে মনোযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে সকল শাস্ত্র এবং গুণীজনেরই মতামত এক।
মনোযোগ বিষয়টি খুব বড়ো। আমাদের বিভিন্ন লেখায় মনোযোগ সম্পর্কে আলোচনা ফিরে ফিরে আসবে। এই অধ্যায়ে মনোযোগ সম্পর্কে অল্প কিছু কথা লেখার চেষ্টা করবো।
শ্রীরামকৃষ্ণ এবং রাণী রাসমণির অমনোযোগ
রাণী রাসমণি (১৭৯৩–১৮৬১) কলকাতার জানবাজারের একজন প্রসিদ্ধ জমিদার ছিলেন। রাণী রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর রাণী রাসমণি জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মানবদরদী রাসমণি মানবসেবা এবং জনহিতৈষী কাজের মাধ্যমে খ্যাতি লাভ করেন। রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের (১৮৩৬–১৮৮৬) অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৮৫৫ সালে রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করার পর রামকৃষ্ণদেব এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় রামকৃষ্ণদেব কালী আরাধনায় এবং সাধনায় তাঁর সমস্ত সময় এবং শ্রম নিয়োগ করেছিলেন। এইখানে লক্ষণীয়, রাণী রাসমণি শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে বয়সে প্রায় ৪৩ বছরের বড় ছিলেন।
একদিন রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে দেবীদর্শনের জন্য এসেছেন। তখন দেবীর পূজা চলছে, রাসমণি কালীদর্শন করলেন। হঠাৎ সকলকে চমকে দিয়ে রামকৃষ্ণদেব এগিয়ে এসে মারলেন এক চড়। আশেপাশের সবাই চমকে উঠলো। এ কী করলেন রামকৃষ্ণ? অত বড়ো একজন জমিদারকে একজন পুরোহিত আঘাত করলেন?
এই ঘটনার অন্য একটি বর্ণনা আছে। সেইটি হলো রামকৃষ্ণদেব রাসমণিকে চড় মারেননি, বরং তাঁর পিঠে চাপড় মেরেছিলেন।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে ১৬ অক্টোবর ১৮৮২–এর দিনলিপিতে সরাসরি এই ঘটনার উল্লেখ আছে। রামকৃষ্ণদেবের নিজের স্মৃতিচারণায়—
একদিন রাসমণি ঠাকুরবাড়িতে এসেছে। কালীঘরে এল। পূজার সময় আসত আর দুই-একটা গান গাইতে বলত। গান গাচ্ছি, দেখি যে অন্যমনস্ক হয়ে ফুল বাচ্ছে। অমনি দুই চাপড়। তখন ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাতজোড় করে রইল।
এরপর রামকৃষ্ণদেব রাণী রাসমণিকে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন— "এইখানে এসেও ওই ভাবনা?" রাসমণি কিছু উত্তর দিতে না পেরে সচেতন হয়ে পুজোর দিকে মনোযোগ দিলেন।
আসলে এইদিন যা হয়েছিল তা হলো রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে এসে কালী আরাধনায় যোগদান করেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল তাঁর বিভিন্ন কাজের দিকে — জমিদারি কাজের বিভিন্ন দায়–দায়িত্ব, লাভ–ক্ষতি, মামলা–মোকদ্দমা — এইসবের দিকে। মন্দিরে কালীপ্রতিমার সামনে উপস্থিত থেকেও তাঁর মনোযোগ ছিল না। সংবেদনশীল শ্রীরামকৃষ্ণ এই অমনোযোগিতা লক্ষ্য করেন এবং সেই অনুযায়ী রাণী রাসমণির মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন।
![]() |
| রামকৃষ্ণদেব (১৮৩৬–১৮৮৬)। রাণী রাসমণিকে তাঁর অমনোযোগিতা সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। চিত্রসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স। |
গুরুদ্বারে মস্তক আবরণ
আপনি হয়তো এই বিষয়ে জানেন এবং লক্ষ্য করেছেন যে গুরুদ্বারে (শিখ মন্দিরে) মাথা ঢেকে রাখা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম। আপনি যদি পবিত্র গুরুদ্বারে প্রবেশ করেন তাহলে আপনার মাথা পাগড়ি, চাদর, রুমাল, দোপাট্টা, আঁচল জাতীয় বস্ত্র দ্বারা সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত থাকা প্রয়োজন।
এই গুরুদ্বারের অভ্যন্তরে মাথা ঢেকে রাখা শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক পরিবর্তন নয়। এর পিছনে কয়েকটি কারণ বলা হয়। যেমন, ১) শ্রদ্ধা ও ভক্তি: শিখ ধর্ম, শিখ গুরু, গুরু গ্রন্থ সাহিবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ২) অহংকার দমন: মাথা ঢাকা মানে নিজের অহংকারকে ঢেকে রাখা, বা "আমি নিজেকে অহেতুক বড়ো ভাববো না" – এই বিনয়ের প্রকাশ।
আমি নিজে শিখ ধর্মের উদারতার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। বহুদিন ধরে নানা গুরুদ্বারে গিয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং মনোনিবেশ করে, আমার খুব মনে হয় যে গুরুদ্বারে মাথা ঢেকে রাখার আরেকটা বড়ো কারণ আছে।
দেখুন, মাথা হলো চিন্তা–ভাবনার প্রতীক। আমাকে যখন বলা হচ্ছে গুরুদ্বারে নিজের মাথা ঢাকা দাও, হয়তো বা তার অর্থ এই যে, এইখানে এসেছো, এখন তুমি তোমার অন্য সব চিন্তা বাদ দাও। নিজের মাথা ঢাকো — নিজের অন্য সব চিন্তা সরিয়ে ফেলো।
বাংলা: গুরু নানকের নাম জাহাজ তুল্য। যে সেই জাহাজে চড়ে সে পাড়ে নিশ্চয় পৌঁছয়।
তবে, মনোযোগের প্রয়োজন তো। পবিত্র গুরুদ্বারে এসেছো, মহান গুরুদের নিকটে রয়েছো। নিজের মাথা (চিন্তা–ভাবনা) আচ্ছাদিত করো। এখন শুধু গুরুর প্রতি মনোনিবেশ করার সময়।
জপ এবং মনোযোগ
একটা সময় আমি বেশ কিছু বড় বড় অফিস বা ব্রেইনস্টর্মিং মিটিং–এ অংশগ্রহণ করেছি। এইসব ব্যয়বহুল আলোচনাসভায় আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং যা নিশ্চিত আপনিও খুব লক্ষ্য করেছেন যে অধিকাংশ মানুষ মনোযোগ দেন না। তাঁরা শারীরিকভাবে সভাস্থলে উপস্থিত, কিন্তু তাঁদের মন যেন অন্য কোথাও পড়ে আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি মিটিং চলাকালীন ল্যাপটপ আর মোবাইল নিষিদ্ধ করা হয়। তবে তা করে অংশগ্রহণকারীদের মনোযোগ বিশেষ কিছু বাড়ে বলে মনে হয় না।
আমাদের এই প্রবন্ধ সিরিজের প্রধান বিষয় জপ। জপের সময়ে মনোযোগ অত্যন্ত জরুরি। এই অধ্যায়ে দুইটি বর্ণনা করেছি। রাণী রাসমণির সাময়িক অমনোযোগিতা এবং গুরুদ্বারে মস্তক আচ্ছাদন সম্পর্কে অভিমত। যখন আমরা জপ করবো, অন্য সব চিন্তা বাদ দিতেই হবে। একাগ্র মনোযোগ প্রয়োজন। যদি একবারেই এই অবস্থায় পৌছনো না যায়, ধীরে ধীরে মনোযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা করতে হবে। নিজের মাথা ঢাকা দিতেই হবে।
জপ বিষয়ক তৃতীয় অধ্যায় এইখানেই শেষ করলাম।
- ● Read in English: First Chapter (Japa definition? Why? When?), Second Chapter (What to Chant?), Third Chapter (Some thoughts on contemplation)
- ● বাংলায় পড়ুন: প্রথম অধ্যায় (জপের সংজ্ঞা? কেন? কখন?), দ্বিতীয় অধ্যায় (কী জপ করবেন?), তৃতীয় অধ্যায় (মনোযোগ সম্পর্কে কিছু কথা)
- ● Tools: Japa Counter, Meditation Timer
This page was last updated on: 26 August 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here

No comments:
Post a Comment
Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.