Sunday, August 24, 2025

জপ — কী জপ করবেন?

জপ, নামজপ বা ধ্যানজপ সিরিজের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করছি। এর আগে জপ সিরিজের প্রথম অধ্যায়ে জপের সংজ্ঞা, জপ করার কারণ ইত্যাদি আলোচনা করেছিলাম। দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়— কী জপ করবেন। বেশ কিছু উদাহরণ এবং বিবরণসহ বিস্তারিত এই বিষয়ে বলার চেষ্টা করবো।

জপ — শব্দের সন্ধানে

জপ করার জন্য আপনার প্রথমেই প্রয়োজন হবে একটা শব্দ। অথবা কয়েকটি শব্দ একত্রে, বা একটা নাম — যেইগুলোও আসলে শব্দই।

দেখুন, শব্দ ছাড়াও অন্যান্য জপ যেমন দৃশ্যজপ, অনুভূতিজপ ইত্যাদি হওয়া সম্ভব। তবে, শব্দজপই সর্বাধিক প্রচলিত, জনপ্রিয়, এবং তুলনামূলকভাবে সহজ। দৃশ্যজপ, অনুভূতিজপ ইত্যাদি এই অধ্যায়ের বিষয় নয়, তবে আপাতত একটা উদাহরণ দিই— ধরুন আপনার কোনও প্রিয় মানুষ। বারবার তাঁর মুখ আপনি কল্পনা করছেন। তাঁর হাসি বা অন্য কোনও দৃশ্য আপনার মনে ভেসে উঠছে। আপনি তাঁর নাম যে বারবার উচ্চারণ করছেন, এমন নয়। শুধু একটা দৃশ্য বারবার আপনার মনে ফিরে ফিরে আসছে। এইটা হলো দৃশ্যজপ। একই ভাবে যদি বিশেষ কোনও অনুভূতি যদি আপনি পুনঃপুনঃ স্মরণ বা অনুভব করেন, তাহলে সেইটা অনুভূতিজপ।

দৃশ্যজপ বা অনুভূতিজপ যে আলাদা করেই করতে হবে, এমন নয়। বিশেষ শব্দ জপের মাধ্যমেই আপনি নাম–রূপ, নাম–গুণ, রূপ–গুণ — ইত্যাদি স্তরও অভ্যাস করতে পারেন। আপাতত এই বিষয় নিয়েই বলি।

জপ — অর্থপূর্ণ নাকি অর্থহীন? 

একটি বা কয়েকটি শব্দ একত্রে নিয়ে জপ শুরু করা যাক। এই শব্দ অর্থপূর্ণ এবং অর্থহীন — দুটোই হতে পারে। সাধারণত অর্থ আছে এমন শব্দ জপ করা অধিক প্রচলিত। অর্থপূর্ণ শব্দ জপ করলে সেইটা মনের মাঝে একটা চিত্র কল্পনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে। ধরুন আপনি একটি নাম জপ করছেন, সেই নাম জপ করার সাথে সাথে আপনার মন নামের সাথে রূপও কল্পনা করছে। আমি একটা শব্দ (নাম) জপের মতো কয়েকবার বললাম—

যীশু, যীশু, যীশু, যীশু।

দেখুন এই নাম জপের সাথে সাথেই মনের মাঝে একটা রূপও ফুটে উঠলো। যীশুর কোনও পরিচিত চিত্র। হয়তো বা যীশুর নাম জপ করার সাথে সাথে ওনার জীবন সম্পর্কে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা, ওনার বিভিন্ন বাণীও আপনার মনের মধ্যে ভেসে বেড়াতে শুরু করলো।

আরও একটি উদাহরণ দিই। 

সৎনাম ওয়াহেগুরু। 
পাঞ্জাবি গুরুমুখী: ਸਤਿਨਾਮ ਵਾਹਿਗੁਰੂ।

শিখধর্মের এই পবিত্র বাণী জপ করলে বোধ হয় মনের মধ্যে ধীরে ধীরে একটা সুন্দর আধ্যাত্মিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। ওয়াহেগুরু বললাম তার মানে সাথে সাথেই ঈশ্বরের নির্দিষ্ট একটা চিত্র মনে ভেসে উঠলো, এমন নয়। শিখধর্মে ঈশ্বরের সর্বজনসম্মত চিত্র বা প্রতিমা নেই। এই নামজপের মাধ্যমে ঈশ্বরের নির্দিষ্ট রূপ না হোক, একটা সার্বিক পবিত্র পরিবেশ, একটা নির্মল বাতাবরণ মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় বৈকি।

শিখধর্মের প্রথম গুরু, গুরু নানকের একটি ঐতিহ্যবাহী ছবি। তিনি শান্ত ও ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে বসে আছেন। তাঁর সাদা দাড়ি, অলঙ্কৃত পোশাক ও পাগড়ি রয়েছে, মুখে শান্ত ও কোমল অভিব্যক্তি। পুরো ছবিটি শান্তি, ভক্তি এবং শিখ শিক্ষার আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
গুরু নানক — নামজপের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর চিত্র। 
সূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

অতএব, আপনি জপ করার সময় অর্থপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। যেমন—

বিষয়  জপের শব্দ 
ঈশ্বরের নাম 
(দৈব নাম) 
রাম, কৃষ্ণ, কালী, আল্লাহ, যীশু, বুদ্ধ, নানক, দুর্গা, ভবানী, প্রমুখ। একই নাম একাধিকবার বা একাধিক নাম একসাথে উচ্চারণ করা যায় যেমন হরেকৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণ, হরগৌরী। 
অনুভূতি প্রেম, শক্তি, বিজয়, শৌর্য, সাহস ইত্যাদি। এইরকম কোনও শব্দ বেছে নিতে পারেন। 
  • শিবোহম (আমি শিব), 
  • অহং ব্রহ্মাস্মি" (আমি ব্রহ্ম), 
  • চরৈবেতি (এগিয়ে চলো), 
  • বন্দেমাতরম্‌ (ভারত দেশমাতৃকাকে স্মরণ করে),
  • আল্লাহু আকবর (আল্লাহ মহান), 
  • লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ভিন্ন কোনও উপাস্য নেই), 
  • বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি (আমি বুদ্ধের শরণে যাচ্ছি), 
  • হ্যালেলুইয়া (ঈশ্বরের মহিমা), 
  • বাবা নাম কেবলম্‌ (প্রভাতরঞ্জন সরকারের স্মরণে), 
  • রামকৃষ্ণ শরণম্‌ (রামকৃষ্ণদেবকে স্মরণ করে), 
  • জয় শ্রী গুরুমহারাজকি জয় ইত্যাদিও জপ করতে পারেন।
ঐতিহাসিক এবং বিশেষ ব্যক্তি শিবাজী মহারাজ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী, মাদার টেরেজা, মনসুর আল–হাল্লাজ, সক্রেটিস, আইজাক নিউটন — এইরূপ কোনও ব্যক্তির নাম যা আপনাকে অনুপ্রেরণা যোগায়। 
অথবা, কোনও ব্যক্তিগত প্রিয় মানুষের নাম বা আপনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, গুরু, শিক্ষক–শিক্ষিকা, প্রিয়তম–প্রিয়তমা ইত্যাদি। 
বিশেষ শব্দ এবং বীজমন্ত্র হ্রীং, ক্লীং, ঐং, ক্রীং, গং (মহামায়া, ভুবনেশ্বরী, মহালক্ষ্মী, কৃষ্ণ, কালী, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীর বীজমন্ত্রসমূহ), রাঃ–স্বাঃ (অনুকূল ঠাকুরের ভক্তরা অনুশীলন করেন। "রাধাস্বামী"–এর সংক্ষিপ্ত রূপ)।
এছাড়া দীক্ষার সময় আপনার গুরু আপনাকে বিশেষ বীজমন্ত্র দিতে পারেন। 

এইভাবে আপনি কোনও নির্দিষ্ট শব্দ বা নাম সশব্দে, বা মনে মনে উচ্চারণ করতে পারেন। আপনি চাইলে সরাসরি কোনও অর্থ নেই এমন শব্দ, যেমন— ত্ররা, ঐযু, ওমি, ব্রীহ্মি ইত্যাদি জপ করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে আপনি নির্দিষ্ট কোনও ধারণা বা রূপের সাথে নিজের জপকে আবদ্ধ করছেন না। যদি অর্থপূর্ণ শব্দ জপ করার সময় মন খুব চঞ্চল হয়, বা মনের মাঝে নানা চিন্তা এসে জপের গতিরুদ্ধ হয়, আপনি সরাসরি কোনও অর্থ নেই, এমন শব্দ জপ করতে পারেন। একইভাবে যদি আপনি রূপ–রস বাদ দিয়ে শুধু জপের শব্দে মনোনিবেশ করতে চান, আপনি এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন।

আমাদের জপের শব্দ অর্থপূর্ণ হোক বা না হোক — সবথেকে এবং একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমরা কতটা মনোযোগ এবং আন্তরিকতার সাথে নিয়মিত জপ করলাম। অনুশীলনের মধ্যে ভালোবাসা না থাকলে মহান ঈশ্বরের নাম বড় বড় বিশেষণসহ বলে গেলেও অগ্রগতি ধীরে হবে।

হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র

চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬–১৫৩৪) ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং পথপ্রদর্শক, যিনি ভক্তি ও নামজপের মাধ্যমে ঈশ্বরের স্মরণকে মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে জনপ্রিয় করেছিলেন। তিনি হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র প্রদান করেছিলেন। 

হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, হরে হরে।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম, হরে হরে।

এই মহামন্ত্রটি শুধুমাত্র নাম বা শব্দের পুনরাবৃত্তি নয়। দুর্দান্ত ছন্দ, গতি, তাল, মাত্রা, শব্দচয়ন, অর্থসংযোগ — সব নিয়ে খুব শক্তিশালী এক মন্ত্র। আপনি কয়েকবার মহামন্ত্র জপ করেন দেখবেন আপনার উচ্চারণ আপনার শ্বাস–প্রশ্বাসের এবং হৃৎস্পন্দনের সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে। আপনার কষ্ট হচ্ছে না। অন্য অনেক শব্দ জপ করার সময় খেয়াল করবেন যেন কষ্ট হচ্ছে, শ্বাস–প্রশ্বাসের গতি, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে। এই এতবার জপ হলো, ওই অতবার জপ হলো — এইসব হিসেব মনকে কষ্ট দিচ্ছে। মহামন্ত্র জপের সময় আপনার সবকিছু অনেক সহজ এবং মোলায়েম মনে হবে। চৈতন্য মহাপ্রভু একেবারে বেছে বেছে সেরা ফুলগুলো দিয়ে পরম যত্নে এক মালা বানিয়ে দিয়েছেন। মহামন্ত্র জপের জন্য অত্যন্ত কার্যকর।

মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ

আমি ওপরে চৈতন্যদেবের মহামন্ত্রের উদাহরণ দিলাম। আপনি বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের অনুশীলনে দেখবেন মহান জনেরা দারুণ সব মন্ত্র প্রদান করেছেন। শিবস্তোত্রম হোক, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র হোক, বুদ্ধধর্মের ত্রিশরণ হোক — এইরকম সব মন্ত্রেই উৎকর্ষতা এবং উপকারিতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। 

আপনি চাইলে যে কোনও শব্দ বা বাক্য জপ করতে পারেন। তবে শাস্ত্র বলে "মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ" — মহাজনেরা যে পথে হেঁটেছেন সেই পথ অনুসরণ করা উচিত। তাই, আপনি আপনার পছন্দমতো যে কোনও ধর্মের, বা কোনও মহামানবের প্রদত্ত বাণী জপ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন।

শব্দের অর্থ ও মনের ওপর ক্রিয়া

একটা সুন্দর তথ্য দিই। একটা শব্দ যখন আপনি বারবার উচ্চারণ করছেন বা ব্যবহার করছেন, সেইটা আপনার মনের ওপর একটা ক্রিয়া করে। তাই ব্যবহারিক মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে দেখলে আপনি আপনার কোনও অনলাইন অ্যাকাউন্টে বা আপনার ডিভাইসে কী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করবেন, সেইটা একটু ভেবে স্থির করা উচিত। এই পাসওয়ার্ড বা পিন আপনি বারবার ব্যবহার করছেন, যদি আপনি একটি শক্তিশালী ও ইতিবাচক শব্দ বা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন, তাহলে এটি আপনার মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, নেতিবাচক বা দুর্বল শব্দ ব্যবহার করলে তা মানসিক শক্তি হ্রাস করতে পারে।

মনোবিজ্ঞানে প্রাইমিং (Priming) নামে একটি ধারণা রয়েছে। প্রাইমিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একটি উদ্দীপক (যেমন একটি শব্দ) চিন্তা বা আচরণকে প্রভাবিত করে। 

জপ করার সময় ব্যবহৃত নাম, শব্দ, বা বাক্য চয়নের সময় মনোযোগ দেবেন। 

মুঘল যুগের একটি ঐতিহাসিক চিত্রকর্ম যেখানে সুফি সাধক মনসুর আল-হাল্লাজের মৃত্যুদণ্ড দেখানো হয়েছে। তাঁকে কাঠের ফ্রেমে বেঁধে রাখা হয়েছে, চারপাশে সৈন্য ও দর্শকরা দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ বেদনায় তাকিয়ে আছে, আবার কারও মুখে কঠোর অভিব্যক্তি। এই দৃশ্য তাঁর শহীদত্বের প্রতীক, যখন তিনি "আনা আল-হক" (আমি সত্য) উচ্চারণ করেছিলেন এবং সেই কারণেই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
মনসুর আল–হাল্লাজ। 
শক্তিশালী বাণী আনা'ল-হক (أنا الحق) ঘোষণা করেছিলেন।
চিত্রসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

প্রিয় ব্যক্তির নাম জপ করবো কি?

প্রিয় ব্যক্তির নাম জপ করতেই পারেন। গুরু, শিক্ষক–শিক্ষিকা, মা–বাবা প্রমুখ এঁদের নাম এবং এঁদের সাথে আপনার সম্পর্ক আপনি জপে ব্যবহার করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে একটা সুবিধা হলো যেহেতু আপনার সেই ব্যক্তির সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভিজ্ঞতা আছে, আপনার মন অনেক সহজে ধারণা করে নিতে পারবে। মন দোদুল্যমান হবে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে বিশেষ অসুবিধা হতে পারে। ধরুন, আপনি পছন্দ করেন এমন কোনও ব্যক্তিকে আপনি বারবার স্মরণ করছেন, কিন্তু কিছু দিন পর দেখলেন আপনি সেই ব্যক্তির কাছ থেকে আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী উত্তর বা ব্যবহার পাচ্ছেন না। হয়তো বা আপনার মনে হতে পারে তিনি আপনাকে তেমন সময় বা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এইরকম সময় আপনার জপ অনুশীলন খুব ধাক্কা পেতে পারে। হয়তো বা কিছু সময় পরে আপনি আপনার স্মরণ–মনন বন্ধ করে দেবেন। মা–বাবা, গুরু — এইরকম সম্পর্কে এই সমস্যা তেমন হবে না বলেই বোধ করি। অন্যান্য যেকোনো সম্পর্কে আপনার প্রত্যাশা যত বেশি, আপনার আশাহত হওয়ার, আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। 

জপ বিষয়ক দ্বিতীয় অধ্যায় এইখানেই শেষ করলাম। 

Japa (জপ)


This page was last updated on: 24 August 2025
Number of revisions on this page: 1
Internet Archive Backup: See here

No comments:

Post a Comment

Please post your comment in this section. Keep it friendly and constructive by following our Comment Policy.
We kindly request you to use your Google account or provide your Name and Website URL when commenting. Please use anonymous comments only if necessary.